“আমার মুখে একটা ব্রণর দাগ‌ও ওর পছন্দ ছিল না! গতবার ৪৭টা কুর্তি আর ১৩টা শাড়ি দিয়েছিল! যাতে প্রতিদিন আলাদা রঙের সাজি! ফিরোজ আমার সব রং নিয়ে চলে গেছে ! তাই আমি শুধুই সাদা পোশাকে”- সুভদ্রা মুখার্জি

শেষ পুজোয় আমার জীবনে যে মানুষটা ছিল, সে-ই সব আলো নিভিয়ে দিয়ে চলে গেল। ফিরোজ়। এখনও অবাক হই, কীভাবে গেল! আর আমি রয়ে গেলাম শুধু সাদা পোশাকে।

২০২৩ থেকে আমার জীবনে পুজো মানেই মৃত্যু। ওই বছরেই বাবা আর শ্বশুরমশাই চলে গেলেন। একসঙ্গে দুই মৃত্যু। ভাবুন তো, একসঙ্গে দুই দিক থেকে ভেঙে পড়া। তার ঠিক এক বছর পর, ২০২৪-এ ফিরোজ়ও চলে গেল। ৩০ সেপ্টেম্বর, ওর চলে যাওয়ার দিন। সেই দিন থেকে আমার কাছে রং বলে আর কিছু নেই।

শেষবারের পুজোয় ফিরোজ় আমাকে ৪৭টা কুর্তি আর ১৩টা শাড়ি দিয়েছিল। কেন জানেন? যাতে এক পোশাক দু’বার না পরি। যেন প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে আমি আলাদা আলাদা রঙে সাজি। ও চাইত আমি সাজগোজ করে থাকি, মুখে একটুও দাগ না পড়ুক। একটা ব্রণ উঠলেও মুখ ভার করত। ও আমাকে সাজিয়ে রাখত, যত্ন করত, চোখে হারাত। এখন আমার জীবনে কে আছে আমাকে এভাবে দেখতে? তাই আমি সাদা বেছে নিয়েছি। আমার সাদা পোশাক, আমার মতোই রংহীন, প্রাণহীন।

Subhadra Mukherjee, Tragic Life, Husband’s Death, Father’s Death, Father-in-law’s Death, Personal Tragedy, Widowhood, Tollywood Actress, Life Struggle, Actress In Grief, White Attire, সুভদ্রা মুখোপাধ্যায়, কষ্টের জীবন, স্বামীর মৃত্যু, বাবার মৃত্যু, শ্বশুরের মৃত্যু, শোকের ছায়া, বৈধব্য, টলিউড অভিনেত্রী, ব্যক্তিগত সংগ্রাম, অভিনেত্রীর কষ্ট, সাদা পোশাক

আমার বাবা খুব শৌখিন ছিলেন। পুজোয় মন প্রাণ ঢেলে দিতেন। নানা রঙের পাঞ্জাবি থাকত তাঁর। বিশেষ করে সাদা পাঞ্জাবির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল আলাদা। আজ বাবার সেই পুরনো সাদা পাঞ্জাবি কেটে জামা বানাই। এক অর্থে, বাবার ছোঁয়া নিয়ে বেঁচে আছি।

ছোট থেকে বাবার কারণে আমার পুজো জাঁকজমকের। রান্না করতে ভালবাসি আমি। আমাদের বাড়ি থেকেই যেত বেলতলা সংঘের অষ্টমীর ভোগ। সেদিন আমি একাই রকমারি নিরামিষ রান্না করতাম। ফিরোজ় সেই ভোগ ভোগ করত। প্রতিটি পদ চেটে-পুটে খেত। অন্য সময়ে আবার ঢালাও মাছ-মাংসের আয়োজন। ও ভোজনরসিক ছিল। আমার রান্না ওর দুর্বলতা।

অনেকে প্রশ্ন করতেন, ফিরোজ় মুসলমান হয়েও কীভাবে আমাদের দুর্গাপুজো এত উপভোগ করত? ও ছিল সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রতীক। দুর্গাপুজো, বড়দিন, এই দুটোই ওর সবচেয়ে প্রিয় উৎসব। বড়দিনে মেয়েকে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে যাওয়া ছিল ওর অভ্যাস। আমি যেতাম না, কারণ লোকজন আমাকে ঘিরে ফেলত। পুজোয় আবার কলকাতায় না থেকে ওর আর চলত না।

কিন্তু এখন? আমি ভেবে পাই না, এত আলো, এত শোরগোল ছেড়ে ফিরোজ় কীভাবে টিকে আছে ওদিকটায়? আমি পারি না, আমি ভেঙে যাই।

Television actress Subhadra Mukherjee, reason behind within acting, famous Bengali TV actress, sudden demise of husband, leave acting, সুভদ্রা মুখোপাধ্যায়, অভিনয় থেকে বিরত থাকার কারণ, জনপ্রিয় বাংলা টেলিভিশনের অভিনেত্রী, স্বামীর অকাল প্রয়াণ, অভিনয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত

এই বছর মহালয়ায় ফিরোজ়কে মনে করে রাজারহাটের এক সাঁওতাল পল্লির মানুষদের পোশাক দিয়েছি। ৩০ সেপ্টেম্বর, ওর প্রয়াণ দিবসে ওর প্রিয় শহর—হায়দরাবাদ, বর্ধমান, কলকাতা, মুম্বই—এইসব জায়গায় দরিদ্র মানুষদের, অনাথ শিশুদের খাবার খাওয়ানোর পরিকল্পনা করেছি। যদিও একদিনে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই কলকাতার সঙ্গে বর্ধমানেও যাব।

গত বছর পাড়ার পুজোর উদ্যোক্তারা আমাকে বলেছিলেন, “দাদা নেই, দিদি, এ বছর অনুষ্ঠান না করি।” কিন্তু আমি রাজি হইনি। কারণ ফিরোজ়ের পছন্দ হত না এসব। ও চাইত না আমি ভেঙে পড়ি, বা ওর অভাবে কোনও কিছু থেমে যাক।

কিন্তু আমার বুকের ভিতরটা জানে, কোথায় আছে ফিরোজ় আমি জানি না। হয়তো কোথাও থেকে সবকিছু দেখছে। যদি দেখে ফেলেই, আমি কিছু না করি? ও কষ্ট পাবে। তাই এই লড়াই। এই শূন্যতার মধ্যে থেকেও আমি যা পারি, করব।

আরও পড়ুন: “নুসরতের সঙ্গে চার-পাঁচটা ছবি করেছি, ওর সঙ্গে এখন বন্ধুত্বের বাঁধন নেই!” “আমরা সবাই মানুষ, অনুভূতি আছে, ক্যামেরার বাইরে অস্বস্তি হলে মুশকিল!”— নুসরতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুললেন অঙ্কুশ!

কেউ কেউ বলে, আমি কেন এভাবে প্রকাশ্যে ফিরোজ়ের কথা বলি? কেন শাড়ি-কুর্তির সংখ্যা, কেন ওর পছন্দ-অপছন্দ খুলে বলি? কিন্তু আমি জানি, ওর প্রতি আমার টান, আমার যন্ত্রণা, এটাই আমার প্রতিবাদ। সমাজের চোখে হয়তো ফিরোজ় শুধু একজন মানুষ। কিন্তু আমার কাছে ও-ই ছিল আলোর উৎসব।

তাই বলি, রংহীন সাদা পরলেও, ভিতরে ভিতরে আমি প্রতিদিন রক্তক্ষরণ করি। ফিরোজ় নেই, অথচ ওর দেওয়া আলোটা এখনও আমার ভেতরে জ্বলছে।