বাংলা চলচ্চিত্র জগতে একেবারে আড়ালে থেকেও নিজের ছাপ ফেলে গিয়েছেন ‘ভীষ্ম গুহঠাকুরতা’ (Bhishma Guhathakurta)। তাঁকে অনেকেই চিনতেন মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’-এর অমল চরিত্রের মাধ্যমে। কিন্তু খেলাধুলোর জগত থেকে এসে বিনোদন জগতে এতটা সাফল্য পাওয়া সত্যিই এক বিস্ময়ের বিষয়। ভীষ্ম তখন ফার্স্ট ডিভিশনের ক্রিকেটার, সেখান থেকেই বাবার অনুরোধে মঞ্চে পা রাখেন। সেদিনের সেই সিদ্ধান্তই তাঁকে একদিন তপন সিংহ আর সত্যজিৎ রায়ের মতো কিংবদন্তির সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে, তা হয়তো তিনিও ভাবেননি।
অভিনয়ের প্রতি প্রথমদিকে তাঁর তেমন ঝোঁক না থাকলেও চরিত্র গড়ে তোলার মধ্যে যে পরিশ্রম দরকার, সেটা তিনি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিয়েছিলেন। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর জন্য গ্রামের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করতে শহুরে অভ্যেস ভেঙে গ্রাম্য রূপ আনতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল তাঁকে। চুল কাটার ধরন, হাঁটাচলার ভঙ্গি, এমনকি দেহভাষার সেই পরিবর্তন দর্শকের চোখে ভীষ্মকে একেবারে বাস্তব করে তুলেছিল। পরে সত্যজিৎ রায়ের টেলিভিশন সিরিজ থেকে শুরু করে সন্দীপ রায়ের ফেলুদা-কেন্দ্রিক সিনেমায়ও কাজ করেছেন।
কাজের মধ্যে দিয়েই বারবার তিনি প্রমাণ করেছেন, বড় চরিত্র না হয়েও পর্দায় স্মরণীয় হয়ে থাকা যায়। তাঁর কেরিয়ারের অনেকটাই গড়ে উঠেছিল নামী পরিচালকদের সঙ্গে নাম জড়ানোর মধ্যে দিয়ে। তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ থেকে শুরু করে সন্দীপ রায়ের ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’ বা ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’— প্রতিটি কাজেই ভীষ্ম এমনভাবে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁকে বাদ দিয়ে গল্প কল্পনা করা যেত না। কিন্তু, পর্দার বাইরে ভীষ্মর জীবনও ছিল নানা টানাপড়েনের সাক্ষী।
ব্যাক্তিগত জীবনে শাশ্বতী গুহঠাকুরতাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। মূলত দক্ষিণী সংগীত একাডেমিতে গান শেখার সূত্রেই দুজনের প্রেম। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতনে চলে যান শাশ্বতী। সেখানে মা-বাবার সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন ভীষ্মও। তারপর বিশিষ্ট সংবাদ পাঠিকা হিসাবে শাশ্বতীর নাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ভীষ্মর সঙ্গে বিয়ের পর এক ছেলে এবং এক মেয়ে হয় তাদের। তাদের মেয়ে শ্রেয়া গুহঠাকুরতা সংগীত জগতে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। শাশ্বতীর সঙ্গে অনেকবার গান গাইতে দেখা গেছে মেয়েকে। সংসার জীবনেও শ্রেয়া অনেক সুখী।
এদিকে শাশ্বতী-ভীষ্মর ছেলে শৌনক এখন কেনিয়াতে স্ত্রী এবং পরিবার সহ বসবাস করছেন। শোনা যায় দীর্ঘদিনের সুখী সংসারের পর শাশ্বতী গুহঠাকুরতা এবং ভীষ্মর অনুচ্ছেদ ঘটে, আজীবন বন্ধুত্ব রেখেছিলেন ভীষ্ম। পরিবর্তীতে শাশ্বতী গুহঠাকুরতা টেলিভিশনের ধারাবাহিক গুলির অন্যতম অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন। এদিকে দীর্ঘদিনের অসুস্থতা এবং করোনা অতিমারির শিকার হয়ে জীবনের শেষ পর্যায় চলে এসেছিলেন ভীষ্ম। অসুস্থতার কারণে জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি প্রায় আড়ালে ছিলেন।
আরও পড়ুনঃ নতুন নারীতে মজে স্বামী! প্রায় দেড় বছর ভারতে না আসেন না মিথিলা! আদৌ কী সৃজিতের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তাঁর? ভারতে না আসার কারণ জানালেন অভিনেত্রী
অবশেষে ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে এক বেসরকারি হাসপালের বিছানায় শুয়েই ৭৩ বছরে তিনি চিরবিদায় নেন। আজও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম উচ্চারিত হলে, মনে পড়ে যায় সেই সব কালজয়ী চরিত্রের কথা। সিনেমার হিরো হওয়ার ইচ্ছে কোনোদিনই ছিল না ভীষ্মর। হয়তো সেই কারণেই নিজের জায়গাটা তিনি গড়ে তুলেছিলেন আড়ালে থেকেই। দর্শক তাঁকে খুব কমই সামনে পেয়েছেন, কিন্তু প্রতিবার দেখেছেন একেবারে নতুনভাবে।