“বুদ্ধিজীবীদের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করছে বর্তমান স্বার্থান্বেষী সরকার…আমরা পরিস্থিতির বদল চেয়েছিলাম সিঙ্গুরে, সরকার পরিবর্তন চাইনি!”— টাটার বিরোধিতা নয়, অন্যায়ভাবে শিল্পকে রুখেছিলেন! বুদ্ধিজীবীদের নৈতিক অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ অপর্ণা সেনের!

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ‘অপর্ণা সেন’ (Aparna Sen) মানে শুধু একজন অভিনেত্রী বা পরিচালক নন, এক সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আট দশক পেরিয়ে গেলেও তাঁর উপস্থিতি আজও ততটাই উজ্জ্বল। বয়স যেন তাঁর ওপর কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি— আজও তাঁর ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য ও ভাবনার গভীরতা সমানভাবে মুগ্ধ করে দর্শক ও সহকর্মীদের। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবহে বড় হওয়া অপর্ণা সেনের পরিবারে শিল্পচর্চা ছিল প্রতিদিনের বিষয়। মাত্র ষোলো বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ ছবিতে অভিনয় করেই প্রথম পর্দায় আসেন তিনি।

পরবর্তী সময়ে ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘পরমা’, ‘ইতি মৃণালিনী’ বা ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’—প্রতিটি ছবিতে তিনি ভেঙেছেন প্রচলিত নিয়ম, সাহসী বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন নিজের মতো করে। বিশেষ করে ‘ইতি মৃণালিনী’ ছবিতে মেয়ে কঙ্কনা সেনশর্মার সঙ্গে সেই জুটি যেন বাস্তব ও পর্দার সম্পর্কের এক সুন্দর মেলবন্ধন। কেবল পর্দাতেই নয়, বাস্তব জীবনেও অপর্ণা সেন সবসময় স্পষ্টভাষী ও নির্ভীক। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি কখনও চুপ থাকেননি। বহুবার বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তাঁর বক্তব্য।

সম্প্রতি তিনি সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা বুদ্ধিজীবী মঞ্চ নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করলেন। তিনি বলেন, “আসলে বুদ্ধিজীবী নামটা জড়িয়ে গিয়েছে বর্তমান সরকারের দুর্নীতির সঙ্গে। সেই সময় যে বুদ্ধিজীবী মঞ্চ নাম দেওয়া হয়েছিল এবং বুদ্ধিজীবী বলতে যদি সত্যিই বুদ্ধিমত্তার হিসেব করা হয়, তাহলে সেই সময়কার অনেক তাবড় তাবড় সব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ছিলেন ওই মঞ্চে। যেমন– শঙ্খ ঘোষ, অম্লান দত্ত, মহাশ্বেতা দেবী, ঋতুপর্ণ ঘোষ, বিভাস চক্রবর্তী। তাদের একসঙ্গে বুদ্ধিজীবী মঞ্চ নাম দেয়, যেটা ভালো অর্থেই দেওয়া হয়েছিল।

তাঁরা সেই সময় যেটা করেছিলেন সেটা মূলত প্রতিবাদটাই মুখ্য ছিল, সরকার-বিরোধিতা নয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে মহাশ্বেতা দেবী তখন বারবার সিঙ্গুর পরিদর্শন করে এসে হতাশ হচ্ছেন পরিস্থিতি ব্যক্ত করতে করতে। এবং সেই মঞ্চে প্রত্যেকের মত আমারও শিল্পায়ন নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু যে পদ্ধতিতে সেই শিল্পায়ন হচ্ছিল, সেটাতেই আমাদের আপত্তি ছিল। মানুষকে গুলি করে জোর জবরদস্তি জমি নিয়ে শিল্প হয় না। আমরা বরাবর উন্নতি চেয়েছি, টাটা না আসুক এটা কখনও চাইনি।

আমরা পরিস্থিতির বদল চেয়েছিলাম, আলাদা করে সরকার পরিবর্তন আমাদের লক্ষ্য ছিল না। এবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে কোন এক দল নিশ্চয়ই সেটার ফায়দা উঠাবে, সেটাই হয়েছে। আমার রাজনীতি খুব সাদা আর স্পষ্ট, কোনও দলের হয়ে কখনোই কথা বলিনি। কিন্তু বুদ্ধিজীবী মঞ্চের অর্থটা খারাপ হয়ে গেল যখন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিছু লোক সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করল। সেটার কলঙ্কটা সব বুদ্ধিজীবীদের গায়ে লেগে গেল সমান ভাবে।

আরও পড়ুনঃ “সফলতার রাস্তা মসৃণ হয় না, সেই পথের কাঁটাগুলো ‘স্ট্রাগল’ নয়!” “যেটাকে আমি প্যাশন বলছি, সেটা কঠিন হলেও আমার নিজের সিদ্ধান্ত!”— প্যাশনকে পেশা বানানোর পথে কষ্ট থাকবেই, আজকের প্রজন্ম ভুলে গেছে পার্থক্যটা! সবকিছুই এখন ‘স্ট্রাগল’, অকপট দেবলীনা দত্ত!

সবাই আমাদেরকে কালিমালিপ্ত করছে, কিন্তু আমার মত কিছু লোক যেমন কৌশিক সেন এবং শঙ্খ ঘোষ, বর্তমান সরকারের বহুবার নীতির সমালোচনা করেছি, বিরোধিতা করেছি। মানুষ এবার সেটা ভুলে গেলে কিছু করার নেই।” অপর্ণা সেনের ব্যক্তিত্বের মূল সুরটাই এই স্বচ্ছতা। তিনি যা মনে করেন, নির্দ্বিধায় তা বলেন। হয়তো সেই কারণেই একদিকে তিনি একাধিক প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আবার অন্যদিকে তাঁর বক্তব্য অনেক সময় বিতর্কও উস্কে দেয়। কিন্তু তিনি তাতে বিচলিত হন না। বরং সোজাসাপটা মতামতই তাঁকে আলাদা করে তোলে।