বাংলার মহানায়ক হলেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সামনে সুপার ফ্লপ! উত্তম কুমারের গলায় চন্ডী পাঠ আজও মেনে নেয় না বাঙালি
বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য, গর্বের ওপর নাম তিনি। তার মৃত্যুর পর বহু বছর কেটে গেছে। কিন্তু আজও তিনিই বাংলা সিনেমার মহানায়ক (Mahanayak)। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে (Bengali film Industry) এই মানুষটার নাম আজও তীব্র সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তার নাম শুনলেই মাথা নত হয় বাঙালির।তিনিই বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতা। তিনিই মহানায়ক উত্তম কুমার (Uttam Kumar) ।
যে মানুষটাকে আজও বাঙালি মাথায় তুলে রাখে, সেই মানুষটাকেই জানেন একবার হতে হয়েছিল চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যাত। আজও মহালয়ার সকালে বাঙালির চোখ খোলে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় স্তোত্র পাঠ শুনে। সে যেন এক অন্য আবেগ অন্য অনুভূতি। এই কিংবদন্তির গলায় চণ্ডীপাঠ না শুনলে যেন পুজোর সেই আমেজটাই আসেনা।
আর তাই আজও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ ছাড়া মহালয়ার ভোর কল্পনা করা দুষ্কর। এতগুলো বছর পেরিয়েও বাঙালি মননে চিরস্থায়ী আসন তার। বেতারেও চণ্ডীপাঠ করে কার্যত বাঙালির কাছে অমরত্ব লাভ করেছেন তিনি। তবে এমন নয় যে বাঙালি সসম্মানে তাকে মাথায় তুলে রেখেছে। তার এই পথ চলাটাও কিন্তু ছিল কন্টকপূর্ণ।
কিন্তু উত্তম কুমারের সঙ্গে কোথায় সম্পর্ক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের? শুধুমাত্র একজন বাচিক শিল্পী নন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার, গায়ক, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। তার মুখস্থ করার ক্ষমতা, বাচনভঙ্গি ছিল দুরন্ত। শুনে শুনে গিরিশচন্দ্র, শেক্সপিয়ারের বড় বড় নাটক তিনি অনায়াস দক্ষতায় মুখস্থ করে ফেলতেন ছোট বয়স থেকেই ।
এই মানুষটি যখন রেডিওতে কাজ করতে আসেন তখন তিনি জন্ম দেন রেডিওর এক নতুন পরিভাষার। রেডিও নাটকের নিজস্ব ভাষার জন্ম দেন তিনি। কীভাবে সংলাপ বলার সময় চোরা দম নিতে হবে, পাতা ওল্টালে পাতা ওল্টানোর আওয়াজ শোনা যাবে না, শুধুমাত্র কণ্ঠস্বরের সাহায্যেই রাগ, দুঃখ, ভালবাসার অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে, মাইক্রোফোন থেকে দূরে গিয়ে কীভাবে সংলাপ বলা যাবে একাধিক খুঁটিনাটি রপ্ত করেছিলেন তিনি৷ শিখিয়েও ছিলেন সবাইকে।
যে মানুষটা রেডিওকে এত কিছু দিয়েছেন সেই মানুষটাকেই রেডিও অপমান অসম্মানের বাইরে বেরিয়ে আর বিশেষ কিছুই দিতে পারেনি। মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের গলায় চন্ডীপাঠ শুনে অভ্যস্ত কান বাঙালির। আর সেখানেই ১৯৭৬ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ পরিবর্তন ঘটায়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে করানো হয়। এমনকী ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নাম পরিবর্তন করে অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয় ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’। পর্দায় মহানায়কের জনপ্রিয়তার কথা ভেবে আকাশবাণীর তরফ থেকে চণ্ডীপাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয় মহানায়ককে।
না এই অফার তিনি ফিরিয়ে দেননি। সম্মতি জানিয়েছিলেন। তবে তিনি প্রথমটা বেশ ইতস্ততই করেছিলেন। ‘চণ্ডীপাঠ’র প্রস্তাব পাওয়ার পর রাজিই হতে চাননি তিনি বলেই শোনা যায়। তবে বেতার কর্তৃপক্ষের অনুরোধ এড়াতে পারেননি মহানায়ক। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি বাঙালি।
উত্তম কুমারের গলায় চণ্ডীপাঠ শুনে একেবারেই খুশি হয়নি বাঙলার মানুষ। উত্তম কুমারের গলায় চণ্ডীপাঠ শুনে শুরু হয় বিক্ষোভ। ব্যাপক ভাঙচুর করা হয় বেতার অফিস। অবশেষে মানুষের চাহিদায় সেই বছর ষষ্ঠীর দিন ফের বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হয়। অপমানিত হয়েও সেই অপমানের যোগ্য জবাব এই ভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। আর যে বাংলার মানুষের কাছ থেকে প্রাণ ভরা ভালোবাসা পেয়েছেন মহানায়ক। সেই দিন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন প্রত্যাখ্যান কাকে বলে। এরপর আর কখনই সেই পথে যাননি উত্তম কুমার।