ভারতীয় সংগীতের অঙ্গনে যে শিল্পীদের নাম দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক হলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার অমর সৃষ্টি মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়া আজও বাঙালির দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ। এটা বাঙালির কাছে নিখাদ আবেগ ছাড়া আর কিছু নয়। যার সুর মূর্ছনাতে এই অসাধারণ জাদু তৈরি হয়েছিল কালের নিয়মে তিনি চলে গিয়েছেন স্মৃতির অতলে যা বেদনাদায়ক।
১৯০৫ এ কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ছোট থেকে মায়ের উৎসাহে গানের প্রতি ভালবাসা তৈরি হয়েছে তার মধ্যে। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র দীপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচর্যে কবিগুরুর গানের প্রতি অনুরাগী হয়ে পড়েন তিনি। বলা যায় রবীন্দ্র সংগীতকে সর্ব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের অবদান অনেকটা। কবিগুরুর ইচ্ছা অনুযায়ী তার বেশ কয়েকটি কবিতায় সুরও দিয়েছেন পঙ্কজ।
ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রথম গেয়ে রেকর্ড করেছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র তথা বাংলা হিন্দি তামিল উর্দু মিলিয়ে বহু সিনেমায় সুর দিয়েছেন। পরবর্তীকালে প্রমথেশ বড়ুয়ার অনুরোধে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন তিনি নিজে। গানের সঙ্গে অভিনয়েও যে তিনি দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন তা তার অভিনীত একের পর এক ছবিই প্রমাণ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে অভিনয়কে কোনদিন তেমনভাবে আমল দেননি পঙ্কজ কুমার মল্লিক। কারণ তার মন বাঁধা পড়েছিল সংগীতে।
পঙ্কজ কুমার মল্লিকের এই প্রতিভাকে ছড়িয়ে দিতে মুম্বইয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বহু নামকরা পরিচালক। এমনকী সেই পরিচালকদের দলে ছিলেন রাজ কাপুর। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তার নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো।
তবে এই রেডিওর মধ্যে দিয়ে জীবনের সব থেকে বড় অপমান সহ্য করতে হয়েছিল পঙ্কজ কুমার মল্লিককে। একবার পঙ্কজকে না জানিয়ে তার মহিষাসুরমর্দিনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে শ্রোতাদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে ওই বছরই ষষ্ঠীর দিন আবার সম্প্রচারিত হয় মহিষাসুরমর্দিনী। তবে আরও এক অপমান তাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল যার উল্লেখ তিনি নিজের আত্মজীবনীতা করে গিয়েছেন। তখন রেডিওতে তিনি মীরাবাইয়ের ভজন শেখাতেন। এমন সময় হঠাৎ একদিন তার বাসভবনের ঠিকানায় এলো একটি চিঠি। যিনি চিঠি লিখেছেন তিনি তৎকালীন বেতার কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর। এই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেওয়া হলো। এর ফলে এক বোবা নির্বাক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। গানকে ভালোবেসে পদ্মশ্রী অর্জন করা এই প্রবাদপ্রতিম শেষ জীবনে এভাবে কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছিলেন।