বাংলা সংগীতজগতের সেই ‘আধুনিক গানের সুচিত্রা’ আজ আর নেই! ৬০০০-এর বেশি গান তাঁর কণ্ঠে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে চলে গেলেন স্বর্ণযুগের সঙ্গীতশিল্পী উৎপলা সেন!

বাংলা সংগীতের ইতিহাসে কিছু নাম চিরস্থায়ী হয়ে থাকেন তাঁদের গানের আবেগ, অভিব্যক্তি এবং সময়কে ছুঁয়ে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য। সেই তালিকার প্রথম সারিতেই থাকবেন ‘উৎপলা সেন’ (Utpala Sen)। ১৯২৪ সালের ১২ই মার্চ ঢাকায় জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর সংগীতযাত্রা শুরু হয়েছিল ছোট বয়সে, মায়ের কাছ থেকে। হিরণবালা দেবী তাঁর প্রথম গুরু, এরপর তালিম নেন উস্তাদ গুল মোহম্মদ খানের কাছে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ঢাকার রেডিও স্টেশনে তাঁর গানের সম্প্রচার হয়। ১৯৩৯ সালে রেকর্ডিং জগতে পা রাখেন, এবং এরপর আর পিছনে তাকাতে হয়নি।

সংগীত জগতে তিনি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন আধুনিক গানে। ১৯৪১ সালে সুধীরলাল চক্রবর্তীর সুরে গাওয়া “এক হাতে মোর পূজার থালি” গানটির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তাঁর কণ্ঠে যে বিষাদের ছোঁয়া ছিল, তা প্রেম-বিরহের গানকে আরও বেশি আবেগঘন করে তুলত। মহালয়ার আগমনী ‘মহিষাসুর মর্দিনী’-তে ‘শান্তি দিলে ভরি’ গানটির মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির ঘরের মেয়ে। চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে সংগীতজগতে যুক্ত হন।

সেই সময় থেকেই তিনি আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পী ছিলেন, এবং বহু যুগান্তকারী গান উপহার দেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রথমে বিবাহ করেন বেণু সেনকে, যিনি অকালেই প্রয়াত হন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে বিয়ে করেন সহশিল্পী ও খ্যাতনামা গায়ক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়কে। এই জুটির গানের রসায়ন এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, তাঁদেরকে বলা হত আধুনিক গানের ‘উত্তম-সুচিত্রা’। পাশাপাশি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বহু ডুয়েট গান শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে তোলে। হেমন্তর মাধ্যমে আশা ভোঁসলের সঙ্গেও তাঁর প্রথম পরিচয়।

পরবর্তীতে যা দুই ধারার সংগীতের মাঝে এক অদ্ভুত সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল। গানে যেমন সৌন্দর্য, তেমনি ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ছিলেন আবেগপ্রবণ। তাঁর উচ্চারণ ঘিরে একটি কাহিনি সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে বহুদিন ধরে ঘোরাফেরা করে। বলা হয়ে থাকে, কাজী নজরুল ইসলাম একবার উচ্চারণের ভুলের কারণে উৎপলাকে ছাত্র তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলেন। তবে পঙ্কজ মল্লিক, যাঁর সুরে একাধিক জনপ্রিয় গান তিনি গেয়েছেন। একটি হিন্দি ছবির গানের রিহার্সালে উচ্চারণ শোধরাতে গিয়ে পঙ্কজ মল্লিক তাঁর নাক চিপে ধরেছিলেন— এমনই কাহিনি প্রচলিত।

আরও পড়ুনঃ একাধিক হিট সিরিয়ালে দর্শকের ভরপুর ভালোবাসা, তবু সিনেমায় সুযোগ নেই! ছোটপর্দার সুপারস্টার রুবেল, কিন্তু বড়পর্দা এখনও দূরে! স্ত্রী বড় পর্দায়, কেন পিছিয়ে পড়ছেন রুবেল? বড় পর্দায় কাজ না পেয়ে আক্ষেপ অভিনেতার!

তিনি উৎপলাকে ‘মৃণাল’ নামে ডাকতেন এবং তাঁর গানের প্রতি দারুণ আস্থা রাখতেন। ২০০৫ সালের ১৩ মে, দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের পর, উৎপলা সেন চিরনিদ্রায় শায়িত হন কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। রেখে যান এক পুত্রসন্তান এবং এক বিশাল গানের ভাণ্ডার, যার অধিকাংশ আজ বিস্মৃতপ্রায়। তাঁর গাওয়া “ময়ুরপঙ্ক্ষী ভেসে যায়”, “পাখি আজ কোন সুরে গায়”, কিংবা “ঝিকমিক জোনাকির দ্বীপ জ্বলে শিয়রে”— এই সব গান আজও সংগীতপ্রেমীদের কাছে অমূল্য রত্ন। যদিও ছয় হাজারের বেশি গান গেয়ে গেছেন, কিন্তু সেগুলোর অনেকটাই আজ রেকর্ড বা সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে।

Disclaimer: এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত মতামত, মন্তব্য বা বক্তব্যসমূহ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি মাত্র। এটি আমাদের পোর্টালের মতামত বা অবস্থান নয়। কারও অনুভূতিতে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, এবং এতে প্রকাশিত মতামতের জন্য আমরা কোনো প্রকার দায়ভার গ্রহণ করি না।

You cannot copy content of this page