বাংলা লোকগানের (Bengali Folk) ঝাঁপি খুললেই কিছু কণ্ঠ আজও বাঙালির হৃদয়ে গুনগুনিয়ে ওঠে। “বলি ও ননদী” কিংবা “বড়লোকের বিটি লো”—এইসব গানে যে গলা প্রাণ দিয়েছিল, সেই ‘স্বপ্না চক্রবর্তী’ (Swapna Chakraborty) আজও আছেন, কিন্তু আলো থেকে বহু দূরে। জীবনের এই অন্তিম অধ্যায়ে এসে যখন অনেক শিল্পী সরকারী সম্মানে ভূষিত হন, তখন স্বপ্না চক্রবর্তী নামটি যেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার পথে। অথচ একদিন যাঁর গানের দখল ছিল শহর থেকে গ্রাম, দেশ থেকে দেশের বাইরে পর্যন্ত।
১৯৫০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বীরভূমের দেরপুর গ্রামে জন্ম স্বপ্নার। মাত্র সাত বছর বয়সে সঙ্গীতের পাঠ শুরু, আর পাঁচ বছর বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে তালিম নেওয়া। আধুনিক গান থেকে লোকগীতি, ভক্তিগীতি থেকে ভাদু – সব ধারায় নিজের কণ্ঠের ছাপ ফেলেছেন তিনি। সিউড়ি শহরেই বড় হওয়া স্বপ্না ছোটবেলাতেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে শুরু করেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে আকাশবাণীতে প্রথম গান করেন, আর সেখান থেকেই শুরু পথ চলা। কিংবদন্তিদের কাছ থেকেও তালিম নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর।
প্রথিতযশা শিল্পী অংশুমান রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভি বালসারা, এমনকি ভূপেন হাজারিকার মতো লোকেদের সান্নিধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে গীতিকার মানস চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন স্বপ্না। ব্যক্তিজীবনে স্থিতি এলেও সঙ্গীতসাধনা চলতেই থাকে। বাংলা চলচ্চিত্রেও তাঁর গানের ছাপ রয়েছে। রেকর্ডিং, অনুষ্ঠান, দেশের বাইরের আমন্ত্রণ—সব কিছুতেই দাপট ছিল তাঁর। বাংলাদেশেও তাঁর লোকগীতি চর্চিত হয়েছে বহুবার। অথচ আজ সেই শিল্পী এক নিঃসঙ্গ জীবনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন।
সিউড়ির একটি বাড়িতে একাই থাকেন তিনি। নেই কোনও সন্তান, স্বামী মানস চক্রবর্তী প্রয়াত হয়েছেন দুই বছর আগে। স্বপ্না চক্রবর্তীর গৃহে এখন শুধুই স্মৃতি। দেওয়ালে ঝোলানো সার্টিফিকেট, স্মারক, ব্যাজ—সব যেন অতীত গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর নিজের বক্তব্যেই স্পষ্ট যে, জীবনে বড় কোনও সরকারি সম্মান পাননি। শিল্পী ভাতা চেয়েও পাননি, চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও ফল মেলেনি। আজও নিজের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান নন, তবে কিছুটা আক্ষেপ থেকে যায়, “হয়তো যোগ্য ছিলাম না, তাই পাইনি।”
আরও পড়ুনঃ অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছে বাংলা! চলছে একনায়কতন্ত্র, সত্যজিতের বাংলায় পুলিশি জোর দেখিয়ে ‘দ্যা বেঙ্গল ফাইলসের’ ট্রেলার বন্ধ করলো বঙ্গ প্রশাসন
কণ্ঠে তীব্র অভিমান আর একফোঁটা ম্লান হাসি নিয়ে বলেন, “রেশনের চালেই চলে যাচ্ছে, আর কিছু চাই না।” তাঁর গলাতেই ঝরে পড়েছে অবহেলিত অথচ আত্মবিশ্বাসী এক শিল্পীর হাহাকার। তবু এত কিছুর মাঝেও তাঁর কণ্ঠ এখনও গুনগুনিয়ে ওঠে পুরনো সেই গানগুলোতে। তাঁর শিল্পীসত্তা আজও জীবিত, জোরালো। যাঁরা একসময় তাঁর গানে বড় হয়েছেন, যারা এখনো তাঁর গান শুনে আপ্লুত হন—তাঁদের দায়িত্ব কি নয়, এই মানুষটির খোঁজ রাখা? এক জীবনের সাধনা, সংস্কৃতির এক জীবন্ত অধ্যায়—স্বপ্না চক্রবর্তী যেন শুধুই স্মরণ নয়, চর্চার বিষয়ও হয়ে উঠুন আগামী প্রজন্মের কাছে।