“এখন আর চেনা ছকের বাইরে কেউ গান শোনে না, আর তাই ভালো শিল্পী এবং তাদের সংগীত অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে!” সংগীত জগতের বর্তমান চিত্রকে তুলে ধরে তীব্র সমালোচনা শান্তনু মৈত্রর!

সদ্য শেষ হওয়া ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের শেষ দিনে যেন অদ্ভুত নীরবতা নেমেছিল অডিটোরিয়ামে। সেদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক ‘শান্তনু মৈত্র’ (Shantanu Moitra)। সংগীত জগতে যার পথ চলার শুরুটা ছিল ঠিক কোনও শিল্পীর মতো নয়। বিজ্ঞাপন সংস্থার চাকরি করতেন তখন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত ছিল একমাত্র নেশা! সেখানেই বিজ্ঞাপনের কাজে প্রথম জিঙ্গল এতটাই সাড়া ফেলে দেয়, যে রাতারাতি আলোচনায় উঠে আসেন তিনি।

এদিন এই পথ চলার কথা বলতে বলতেই তিনি কখনও হাসলেন, কখনও যেন স্মৃতির ভেতরে কিছু খুঁজে নিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের একেবারে শেষ অংশে এসে তিনি যে কথাগুলো বললেন, তা সেদিনের সব আলোচনাকে ছাপিয়ে গেল। একসময় ‘পরিণীতা’ ছবির সুর দিয়ে বলিউডে নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন তিনি। তারপর একের পর এক কাজ– কখনও বড়পর্দা, কখনও জিঙ্গল আবার কখনও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুর।

কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠিত পথ পেরিয়ে যখন তিনি বলেন শিল্পী নয়, শিল্পই আসল! তখনই বোঝা যায় তাঁর কাজের প্রতি সততা কতটা। তাঁর কথায়, গান তৈরি হওয়ার আগেই তিনি নিজের মনে মনেই শুনে ফেলেন যে কোন গায়কের গলায় সেটা নিখুঁতভাবে ধরা দেবে। সেই গায়ককে থেকে না শুনলে তিনি অনেক সময় সেই গানই বানান না! এই কঠোরতা আসলে তাঁর দায়বদ্ধতা, নিজের প্রতি এবং গানের প্রতি। তবে আড্ডায় সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছে তাঁর বর্তমান সঙ্গীতজগত নিয়ে আক্ষেপ।

আজ রেডিওর দিন নেই, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম অসংখ্য, তাই মানুষের কাছে অপশনও অসীম। কিন্তু এই স্বাধীনতার মাঝেই নাকি হারিয়ে যাচ্ছে মৌলিকতা! শিল্পীরা চেষ্টা করছেন, কিন্তু শ্রোতারা নিজেদের পছন্দের ঘরানার বাইরে বেরোতেই চাইছেন না। ফলে যেসব শিল্পী অন্য ধারা নিয়ে কাজ করছেন, যাঁদের সুর অন্যরকম পথ দেখাতে পারে– তাঁদের অনেকেই অন্ধকারে রয়ে যাচ্ছেন। আর একেবারে শেষে তিনি যে কথাগুলো বললেন, সেগুলো শুনে অনেকেরই চোখ ভিজে এল।

কারণ সেই কথায় ছিল এই সময়ের সংগীতশিল্পীদের আটকে থাকার যন্ত্রণা আর ছিল শ্রোতাদের কাছে একটা নীরব আবেদনও, “আমাদের গণ্ডিতে আসতে আসতে অনেক ছোট হয়ে যাচ্ছে, গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন আর আগের মত হচ্ছে না। রেডিওর যুগে মানুষের কাছে এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না, তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল না যে নিজের পছন্দের গান বেছে নেবে। ফলে যা শোনানো হতো তাই সবাই শুনত। এখন সবার হাতে ক্ষমতা আছে পছন্দের গান বেছে নেওয়ার, ফলে আর কেউ তার বাইরের কোনও গান শুনছেন না!

আরও পড়ুনঃ পার্শ্ব চরিত্ররা সব সময় অবহেলার শিকার হন! ভিলেনরা গল্পের মূল স্তম্ভ হলেও তারা সেই সম্মান পায় না! অকপট ‘রাজরাজেশ্বরী রানী ভবানী’র ‘ফুল্লরা’ পূর্বাশা

ফলে অনেক ভালো শিল্পী এবং তাদের সংগীত অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে।” শান্তনু নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেন, বড় প্রযোজনা থেকে বড় বাজার বা বড় বাজেটের সঙ্গে তাঁর সুরকার সত্তার মানানসই নয়। তাঁর কাছে গান মানে অনুসন্ধান, নিরীক্ষা এবং ঝুঁকি নেওয়া। তাই বাজারের চাপ বা ট্রেন্ডের দাপটে তিনি নিজের ভাষা বদলাতে চান না। বরং শ্রোতার অভ্যাসটাই তাঁর কাছে বড় প্রশ্ন, ‘শ্রোতা যদি নতুনকে সুযোগ না দেন, তাহলে শিল্পীরা কেন এবং কার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন?’