‘কৃষ্ণ ভজন ও মা কালীর গানে আপত্তি, পরে হয়তো গানটাই কেড়ে নেবে!’ ‘সংখ্যায় কম তাই নিষেধাজ্ঞা, বাড়লে হাত উঠতেও পারে!’ শিল্প ধর্মের খাঁচায় বন্দি নয়! লগ্নজিতার পর, লোকসংগীতের মঞ্চে হেনস্থার শিকার শিল্পী মধুবন্তী মুখার্জী! ঠিক কী ঘটেছে?

ভগবানপুর এলাকার একটি অনুষ্ঠানে সম্প্রতি যা ঘটেছে, তা নিয়ে আর নতুন করে কিছু বলার নেই। এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়, তবু প্রতিবারই প্রতিবাদের সুর দেখা যায় না। এদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তীর (Lagnajita Chakraborty) সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা শিল্পীর নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে আবার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। গান চলাকালীন দর্শকাসন থেকে উঠে, মঞ্চে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হুশিয়ারি এবং কর্তৃপক্ষের তরফে কটাক্ষ মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি মাঝপথেই থেমে যায়। ‘সেকুলার গান গাইতে হবে’, এই দাবির আড়ালে যে অসহিষ্ণুতা কাজ করছে, তা এই ঘটনার মধ্য দিয়েই যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে!

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা সামনে আনেন লোকসংগীত শিল্পী মধুবন্তী মুখার্জী (Madhubanti Mukherjee)। তবে তাঁর ঘটনাটি ঘটেছে একেবারেই ভিন্ন পরিবেশে লোকসংস্কৃতির মঞ্চে, লালন উৎসবে। কৃষ্ণগঞ্জের সেই অনুষ্ঠানে শুরুটা ছিল স্বাভাবিক এবং সহযোগিতামূলক। আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে, নির্দিষ্ট ধারার গান গাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়াও ছিল ইতিবাচক, গান উপভোগ করছিলেন সবাই। সমস্যা তৈরি হয় একটি নির্দিষ্ট গানের পর। গান শেষ হতেই হঠাৎ এক ব্যক্তি মঞ্চে উঠে একই রকম আচরণ করেন!

এটি যে শুধু শিল্পীর প্রতি অসম্মানজনক নয়, মঞ্চের শালীনতাকেও ভেঙে দেয়! মধুবন্তী সেই মুহূর্তে কোনও বড় প্রতিবাদে যাননি, মূলত আয়োজকদের এবং অনুষ্ঠানের সামগ্রিক পরিবেশের কথা ভেবে। তবে, পরবর্তীতে সমাজ মাধ্যমে একটি ভিডিও করে তিনি সবটা জানান। তাঁর কথায়, “আমাকে বলা হয়েছিল, সেখানে শুধু লোকসংগীত গাইতে হবে। আমি, আমার ব্যান্ড নিয়ে সেভাবেই প্রস্তুতি রেখে গিয়েছিলাম। এখানের পরিবেশ এবং কমিটির সদস্যরা সবাই খুব ভদ্র। সেখানে আমি নিজের পছন্দের একটি গান গাই, উস্তাদ শাহ আবদুল করিমের ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও’।

শ্রোতারা খুব উপভোগ করেছেন গানটা, ভীষণ সহযোগিতাও পেয়েছি। কিন্তু গানটির শেষে, হঠাৎ করে এক ভদ্রলোক মঞ্চে উঠে এসে অত্যাধিক দুঃসাহস দেখিয়ে আমার হাত থেকে মাইক্রোফোনটা ছিনিয়ে নেন! উনি তারপর শ্রোতাদের বলেন, ‘এই জাত-পাতের গান শুনবো না, আমরা কোনও ধর্মের গান শুনবো না। আপনি অন্য গান করুন।’ আমি অবশ্যই এই ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে পদক্ষেপ নিতাম, কিন্তু নিইনি ওখানের কমিটির সদস্যদের কথা ভেবে। তারপরেই কমিটির একজন অত্যন্ত ভদ্রলোক মঞ্চে এসে, শ্রোতাদের সবাইকে জানিয়েছেন ‘শিল্পী তার মনের মতোই গান পরিবেশন করবেন।

আপত্তি থাকলে সোজা বেরিয়ে যান।’ ওনার শুধু এই মানবিক পদক্ষেপের জন্যই, আমি কোনও বাড়তি ঝামেলা করিনি। কিন্তু রোজ সঙ্গীতশিল্পীরা এভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন, জাত-পাত-ধর্ম ইত্যাদি টেনে আনা হচ্ছে শিল্পের মধ্যে! সেকুলার গান নাকি গাইতে হবে! আমার জানা নেই যে গান কী করে সকুলার হয়?” তবে তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে আরও বড় এক আশঙ্কা। বারবার শিল্পীদের ‘কী গান গাওয়া যাবে’ সেই তালিকা ধরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ধর্ম, জাত বা তথাকথিত সেকুলার তকমা দিয়ে গানকে ভাগ করার চেষ্টা শিল্পের স্বাভাবিক প্রবাহের পরিপন্থী।

আরও পড়ুনঃ “যেই গাছে ফল হচ্ছে, তাকেই কেটে দিচ্ছো! এটা কি ইন্ডাস্ট্রির ভালোর জন্য, না দেবকে আটকানোর জন্য?” ২০২৬ সালের পুজোয় ছবি মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা! টলিউড স্ক্রিনিং কমিটির মিটিং ঘিরে দেবের বিস্ফো’রক দাবি! মুখ খুলতেই কি মিলল না হল?

মধুবন্তীর কথায়, গান নিজেই অনুভূতির ভাষা আর তাকে আলাদা করে শ্রেণিবদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। আজ যদি এই আপত্তি কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, ভবিষ্যতে তা অন্য রূপ নিতে পারে। এই সতর্কবার্তাই তিনি দিয়েছেন, “প্রত্যেক শিল্পীকেই নিজেদের মতো প্রতিবাদ করা উচিৎ! সময় থাকতে সতর্ক হোন, কারণ এরা এখন সংখ্যায় কম বলে শুধু মুখে বলছে যে কৃষ্ণ ভোজন বা মা কালীর গান গাওয়া যাবে না। সংখ্যায় বাড়লে হয়তো, মুখ থেকে হাতে চলে আসতে পারে এই নিষেধাজ্ঞা!” সমাজ মাধ্যমে তাঁর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে সমর্থনের ঢেউ উঠেছে, তা প্রমাণ করে যে অনেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছেন, শিল্পীর পাশে দাঁড়িয়ে।

You cannot copy content of this page