“রাতে ভোজ আছে, তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভোজটা সারি!”— ‘ধ’র্ষণের রাজ্যে’, স্টার জলসার ‘লক্ষ্মী ঝাঁপি’ ধারাবাহিকের বিতর্কিত সংলাপ! যে বাংলায় প্রতিদিন ধ’র্ষণের খবর, সেই বাংলায় সিরিয়ালে এমন ইঙ্গিত কি নিছক বিনোদন? পর্দায় এমন সংলাপ কি অপরাধ নয়?

টেলিভিশন মানেই বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কিন্তু সেই মাধ্যমেই যদি মিশে যায় সমাজের সবচেয়ে অন্ধকার দিকগুলোর অবচেতন উস্কানি, তখন প্রশ্ন তো উঠবেই। সম্প্রতি স্টার জলসার (Star Jalsha) জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘লক্ষ্মী ঝাঁপি’ (Lakshmi Jhaapi) এক দৃশ্যে এমন কিছু সংলাপ ব্যবহার করেছে, যা কেবল ‘বিতর্কিত’ বললে কম বলা হয়। এখানে শুধু গল্পের গতি নয়, প্রশ্ন উঠছে নির্মাতাদের মানবিক দায়িত্ববোধ নিয়ে। কল্পনার নামে একটা সামাজিক ট্রমা, যা প্রতিদিন হাজারো মেয়ের জীবনের দুঃস্বপ্ন! তাকে হালকা ঠাট্টার ছলে পরিবেশন করা কি একধরনের অপরাধ নয়?

ধারাবাহিকের এক দৃশ্যে খলচরিত্ররা যেভাবে নায়িকাকে দেখে ‘ভোজ’ বলছে এবং সেটা আনন্দের সুরে বলছে তা কেবল রুচিহীন নয়, অপ্রত্যাশিতও! “এতো খাসা মেয়ে রে! আজ রাতে ভোজ আছে।” “ছেড়ে তো দেবই। ভোজটা আগে হয়ে যাক! তাড়িয়ে তাড়িয়ে ভোজটা আগে সারি!” এসব সংলাপে যে ধরণের ভাষা ব্যবহার হয়েছে, তাতে খুব সহজেই এমন একটা বার্তা পৌঁছায় যে, এই সমাজে নারীর উপর সহিংসতা একপ্রকার বিনোদনের উপাদান! অথচ এই বাংলা থেকেই কত প্রতিবাদ, কত পদযাত্রা হয়েছে নারী নিরাপত্তা নিয়ে।

তখন কি এসব চিত্রনাট্যকার, নির্মাতা, প্রযোজক একটু থেমে ভেবেছেন-তাদের গল্পগুলো কতটা প্রভাব ফেলতে পারে একজন তরুণ দর্শকের মনে? এটা ঠিক, ধারাবাহিক মানেই সবসময় বাস্তব নয়, অনেক সময়ই অতিনাটকীয়। কিন্তু সেই নাটকীয়তার মধ্যে কিছু ন্যূনতম সামাজিক দায়িত্ব থাকতেই পারে। ধ’র্ষণের মত ভয়াবহ অপরাধ নিয়ে যদি এমনভাবে ‘মজা’ করা হয়, তবে তা আর গল্পের গরিমা থাকে না, থেকে যায় কেবল অবমাননার গন্ধ। একজন মহিলা চরিত্রকে শুধু দুর্বল বানিয়ে, তার উপর শারীরিক নির্যা’তনের আশঙ্কা তুলে, দর্শকের সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টাটা কোনও সৃজনশীলতার চিহ্ন নয়!

বরং তা সহজে নাম কমানোর লোভে নেমে আসা সস্তা কৌশল। আরও কষ্টের বিষয়, এসব দৃশ্য পেরিয়ে গেলেও, আমাদের সমাজের অনেকেই সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেউ কেউ বলেন, “ও তো গল্প, সিরিয়াল!” কিন্তু সেই ‘গল্প’ই তো নির্ধারণ করছে আমাদের সমাজ কোন দিকটা দেখতে চায়, কোনটা হজম করতে শিখছে। টেলিভিশন শুধুই একটা মাধ্যম নয়, তা সমাজের অনেক বড় আয়না। আর যদি সেই আয়নাতেই নারীর অসহায়তা বারবার একই চেহারায় ফিরে আসে, তাহলে কি করে আমরা আশা করব, এই চিত্র একদিন বদলাবে?

আরও পড়ুনঃ আমাকে নিয়ম শেখাতে আসবেন না আমার সব জানা আছে! কেবিসির মঞ্চে অমিতাভ বচ্চনের মতো কিংবদন্তির সামনে খুদে প্রতিযোগীর কথা বলার ধরণ দেখে স্তব্ধ নেটপাড়া

আমরা যদি সত্যিই চাই সমাজটা একটু নিরাপদ হোক, একটু সচেতন হোক, তাহলে প্রথমে গল্পগুলো বদলাতে হবে। এমন দৃশ্য বা সংলাপ দিয়ে দর্শকের মগজে ভয়ের চেয়ে স্বাভাবিকতা গেঁথে দিলে, একদিন সেই ভয়টাই হারিয়ে যাবে। নির্মাতারা চাইলে সংলাপটা অন্যভাবে বলতেই পারতেন— অপমান নয়, আশঙ্কার অনুভব তৈরি করে। গল্পের খলচরিত্র থাকুক, বিপদ থাকুক, কিন্তু সেই বিপদের ভাষা যদি সভ্য না হয়, তবে সে গল্প শুধু বিনোদন নয়, একটা সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আর আমরা সেটাই কি চাই?