ব্যক্তিগত এক ক্ষোভের কারণেই শেষ জীবনে কাজ ছেড়ে দেন নিমু ভৌমিক! কী সেই কারণ?
কৌতুক অভিনেতা (Comic actor) থেকে খলনায়ক (Villen) সব রকম চরিত্রে যিনি দাপটের সাথে অভিনয় করেছেন, তিনি হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের (bengali film industry) জনপ্রিয় অভিনেতা (Actor) নিমু ভৌমিক (Nimu Bhowmik)। তার হাসির নামই হয়ে গিয়েছিল মিছরির ছুরির মতো হাসি। কিন্তু এই মানুষটা এক ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কারণে শেষ জীবনে কাজ কমিয়ে দিয়েছিলেন! কী ছিল অভিনেতার মনের মধ্যে জমে থাকা সেই ব্যক্তিগত ক্ষোভ? তাই বলব, আজকের প্রতিবেদনে।
আটের দশকে বেশিরভাগ বাঙালি পরিবারগুলো ছিল যৌথ, ফোন কল নয়, হঠাৎ করে বাড়িতে হাজির হতেন মানুষ। তারপর অতিথি হিসেবে খেতেন এক থালা ভাত, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রাঁধা কচুর শাক। এমনই দৃশ্য ছিল অঞ্জন চৌধুরীর ছোট বউ ছবিতে, সেখানে হঠাৎ আগন্তুক মামার চরিত্রে অভিনয় করে নিমু ভৌমিক সকলের মনের মনিকোঠায় জায়গা করে নেন। তবে একজন শক্তিশালী অভিনেতা হওয়ার পরেও কমিক আর ভিলেন চরিত্রেই তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গিয়েছেন-এই আক্ষেপ তার মনে যেমন ছিল তেমনি বাংলা চলচ্চিত্র প্রেমীদের মনেও রয়ে গিয়েছিল।
তার হাসি আর ডায়লগ ডেলিভারি দিয়েই তিনি বাজিমাত করতেন ছবি। তবে সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন জাত অভিনেতা, পজেটিভ হোক অথবা নেগেটিভ, কমিক হোক অথবা কোন শেডের ক্যারেক্টার-যে কোনও চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারতেন অনায়াসে। তবে বাংলা চলচ্চিত্র তাকে সেইভাবে ব্যবহার করে নি। চলচ্চিত্র, বেতার নাটক, যাত্রা, পেশাদার থিয়েটার, টেলিভিশন ,সিরিয়াল সব ক্ষেত্রেই তার অভাবনীয় প্রতিভা ফুটে উঠেছে।
ছোট থেকেই নাটক অভিনয়ের প্রতি তার অত্যাধিক ঝোঁক ছিল। উত্তম-সুচিত্রার অভিনয় দেখেই পর্দার জগতে প্রবেশ করার কথা ভাবেন তিনি। কলেজে পড়া শেষ না করেই উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় ছুটে আসেন অভিনয়ের টানে। টালিগঞ্জে বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর সলীল দত্তের মনিহার ছবিতে সুযোগ পান তিনি। পেয়ে যান বিশ্বজিৎ, সন্ধ্যা রায় ও ছায়া দেবীর সাথে স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ।
এরপর পূর্ণেন্দু পত্রীর স্ত্রীর পত্রতে বিন্দুর বরের ভূমিকায় অভিনয় করেন। বিজয় বসুর বাঘিনী,সাহেব,তরুণ মজুমদারের গণদেবতা,দাদার কীর্তিতে তার অভিনয় দাগ কেটে যাওয়ার মত। মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে দুই পৃথিবী,বিকেলে ভোরের ফুল এ অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন আবার সুচিত্রা সেনের ভাইয়ের ভূমিকার অভিনয় করেন নিমু ভৌমিক ‘হার মানা হার’এ। সাহেব ছবিতে তার নেগেটিভ চরিত্র দাগ কাটে মানুষের মনে আবার দেবিকা ছবিতেও ভয়ঙ্কর নেগেটিভ রোল করেন তিনি।
তবে তার কতগুলি কাজ নিয়ে কথা খুব কম হয়, যেমন ইন্দর সেনের অসময় ছবিতে মোহিনীর বরের ভূমিকায় অভিনয় বা পূর্ণেন্দু পত্রীর ছেঁড়া তমসুতে তার অভিনয় অসাধারণ ছিল। রাজা মিত্রের যতনের জমিতেও অভিনয় করেন তিনি। বড় পর্দার পাশাপাশি আর্ট ফিল্মেও অভিনয় করেছেন নিমু ভোমিক। ছোটবউ, মঙ্গলদীপ, বিধিলিপি,মহাজন,গুরুদক্ষিণা ইত্যাদি ছবিতে নেগেটিভ রোলে অভিনয় করা নিমু ভৌমিকই প্রিয়জন ছবিতে ছোটকার মত ভোলাভালা বরের পজেটিভ চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ দক্ষতায়।
২০১৪ সালে বিজেপির প্রার্থী হয়ে লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ থেকে দাঁড়িয়েছিলেন নিমু ভৌমিক। জোর গলায় তিনি বলেছিলেন, আমি অভিনেতা নই, দিনাজপুর তথা রায়গঞ্জের ভূমিপুত্র হয়েই ভোটে জিতব। যদিও তিনি জিততে পারেন নি। সিপিএমের মোহম্মদ সেলিমের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি তবে নিজের জায়গা থেকে হেরে যাওয়ার ক্ষোভ তার শেষ সময় অবধি তাড়া করে বেরিয়েছিল তাকে।
আরও পড়ুন: একচোখা বাবা! আদরের সোনাকে বাঁচাতে মহাপ্রলয়ে রূপাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো সূর্য
তার বয়স বোঝা যেত না। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি খুব আমুদে ছিলেন। সেই কারণে সকলকে নিজের বয়স জিজ্ঞেস করতেন কেউ ৬০ বললে,হেসে বলতেন ভুল, আমার বয়স ৮০। শেষ জীবনে তিনি হিন্দি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। তার অভিনীত শেষ ছবি ছিল দশ মাস দশ দিনের গল্প। তবে শেষের দিকে কাজ কমিয়ে দেন নিমু ভৌমিক ভালো রোলের অভাবে ও একই ধরনের রোল করতে করতে তার মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা কাজ করতে থাকে। তাছাড়া নিজের জন্মভূমি থেকে হেরে যাওয়ার একটা কষ্ট ছিল তার মনে,তিনি ভাবতেন তাহলে পাবলিক কি তাকে ভিলেন বলেই মনে রাখল! ২৭ শে আগস্ট ২০১৯ সালে গড়িয়ার বাড়িতেই ৮৮ বছর বয়সে মারা যান অভিনেতা। বার্ধক্য জনিত সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি,এরপর বাড়ি ফিরে আসেন,তবে বাড়ি ফেরার পর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার,যার ফলে জীবন অবসান হয় তার।