বাঙালির মননে আবৃত্তি শব্দটা শুনলেই যাঁর নাম আপনাআপনি ভেসে ওঠে, তিনি আর কেউ নন বরং আমার, আপনার, সবার প্রিয় বাচিকশিল্পী ‘ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়’ (Bratati Bandyopadhyay)। ব্রততীর জীবন যেন আবৃত্তি আর শিক্ষার মেলবন্ধনের গল্প। একসময় মঞ্চই ছিল তাঁর পৃথিবী, যেখানে তিনি নিজের সত্তাকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। দর্শকদের সামনে দাঁড়িয়ে শব্দের আবেগ পৌঁছে দেওয়াই ছিল তাঁর সাধনা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে এখন।
একসময়ে চেয়েছিলেন, ট্রাফিক পুলিশ থেকে রাষ্ট্রপ্রধান যেন তার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়! পরে পরিচিতজনদের বারবার অনুরোধে তিনি শিক্ষকতার দায়িত্ব নিতে শুরু করেন। শুরুতে মনে হয়েছিল, এটি হয়তো কেবলই অন্যের চাওয়ার কাছে মাথা নোয়ানো। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারলেন, এই নতুন পথও তাঁকে অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের শেখাতে শেখাতে তিনিও শিখলেন অনেক কিছু। বিশ্বজোড়া খ্যাতি যে শিল্পীর, তার এই শিল্পে যুক্ত হওয়ার গল্পটাও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর না!
ছোট থেকেই বাবার কেনা টেপ রেকর্ডারে কবিতাপাঠ শুনে শুনে আয়ত্ত করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঞ্চিয়তা ছিল তাঁর প্রিয় সঙ্গী। বড় হতে হতে স্কুল-কলেজের নানান প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে পুরস্কার আনতে শুরু করেন তিনি। আবৃত্তিতে এতটাই ভালো ছিলেন ব্রততী যে, ইউনিভার্সিটি বাইরে ফুচকা বিক্রি করা কাকুটিও তাকে ‘কবিতা দিদিমণি’ বলে ডাকতেন। পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন মোটা টাকার চাকরিও।
কিন্তু সেই সঙ্গে দূরদর্শনের খবর পাঠিকাও ছিলেন, আর আবৃত্তি তো ছিলই। এতকিছু একসঙ্গে সামলাতে পারছিলেন না, সেই সময়ে শিল্পের তাগিদে চাকরি ছাড়েন তিনি। ব্রততীর কথায়, “কবিতার জন্য চাকরি ছেড়েছিলাম। মোটা মাইনের চাকরি, ছাড়ার দু’মাস পরেই দেখি হাতে আর টাকা নেই। মাত্র ৩০০ টাকা দিয়ে মাস চালিয়েছি। পেশা করবো ভাবিনি আবৃত্তিকে। সেই সময় আবৃত্তি পরিষদের চর্চা করছি। পরিষদের সংগঠক সুবীর চট্টোপাধ্যায় একদিন আমাকে বললেন, ‘তুই তৈরি হয়ে যা।
একক সন্ধার আয়োজন করছি রবীন্দ্রসদনে।’ সেই থেকেই আমার যাত্রা শুরু। ১৯৯৬, ৭ ডিসেম্বর ‘এক সন্ধে একা ব্রততী’, বাকিটা তো তারপর ইতিহাস। সেদিন সাধারণ মানুষের ভিড় যেন সামাল দেওয়া যাচ্ছিলো না রবীন্দ্র সদনে। শুভ দাশগুপ্তের ‘আমি সেই মেয়ে’ নিয়ে প্রথম ক্যাসেট বেরোয় আমার। যেন একটা ঝড় তুলেছিল সেই সময়, যাকে বলা যায় আবৃত্তির নবজাগরণ। চাষীর ঘরেও বাজত, রেডলাইট এলাকাতেও বাজত। আমাকে ফোন করে পতিতারা প্রশংসা করতো।
ওদের কষ্ট তুলে ধরার জন্যে অনেকে উপহার পাঠাতো। ‘না বলা চিঠি’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখা কবিতা এমন হিট হলো আমার কণ্ঠে যে, একটি মেয়ে এসে কেঁদে বলেছিল ‘আপনি কী করে জানলেই আমার মনের কথা!’ বছর কুড়ি আগে এক ছেঁড়া শাড়ি পরা বৃদ্ধা আমার অনুষ্ঠান শেষে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি জানান, এক সময়ে তিনিও আবৃত্তি করতে চেয়েছিলেন। সংসারের চাপে সেসব ভুলতে হয়েছে, এখন লোকের বাড়িতে কাজ করেন।
আমার আবৃত্তি শুনে তার এত ভালো লেগেছে, রোজ নিজের রোজগারের একাংশ আমার উপহারস্বরূপ তুলে রাখতেন। দশ হাজার টাকার মতো জমিয়ে আমাকে দিয়ে তিনি বলেছিলেন একটা উপহার কিনে নিতে। ফেরাতে পারিনি তাঁকে সেদিন।” এক সময়ে এই আবৃত্তি করেই ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ, মহাদেশ। ইতালির যদি ‘অপেরা’ থেকে তবে বাঙালির আছে ‘মঞ্চ-নাটিকা’, ‘আবৃত্তি’। আর আবৃত্তি বা বাচিকশিল্প যতদিন থাকবে– আর কেউ থাকুক বা না, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নাম অমর থাকবে আজীবন।
আরও পড়ুনঃ “প্রথম অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন একজন চা বিক্রেতা” ছোট চরিত্র থেকে আজকের নায়ক, চা-ওয়ালাই বদলে দিয়েছিল জীবন! কী করে অভিনেতা হলেন হানি বাফনা? শুনলে অবাক হবেন আপনিও!
Disclaimer: এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত মতামত, মন্তব্য বা বক্তব্যসমূহ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি মাত্র। এটি আমাদের পোর্টালের মতামত বা অবস্থান নয়। কারও অনুভূতিতে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, এবং এতে প্রকাশিত মতামতের জন্য আমরা কোনো প্রকার দায়ভার গ্রহণ করি না।