বাংলা চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন জগতে এক পরিচিত নাম ‘অরুণাভ দত্ত’ (Arunavo Dutta) । বাংলা এবং হিন্দি, দুই জগতেই তিনি বেশ জনপ্রিয় এখন। বাংলার বড়পর্দায় তিনি কাজ করেছেন ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘যমের রাজা দিল বর’, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ এবং ‘হীরক জয়ন্তী’র মতো ছবিতে। আবার হিন্দিতে ‘আই অ্যাম ইন্ডিয়ান’ ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি ২০১৮ সালে প্রযোজনা করেছিলেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য অটাম লিফ’-এ। বাংলার ছোটপর্দাতেও তিনি সমানভাবে সক্রিয়, মূলত নেতিবাচক চরিত্রে দর্শকের মনে দাগ কেটেছেন।
বিশেষ করে স্টার জলসার ‘দুই শালিক’-এ আইনজীবীর ভূমিকায় তাঁর অভিনয় যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল কিছুদিন আগে। সিনেমা থেকে শুরু করে ধারাবাহিক— সব ক্ষেত্রেই তিনি নিজের ছাপ রেখেছেন তবে, অভিনয় জীবনের এই দীর্ঘ যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। ছোট চরিত্র দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। আজ তিনি যে চরিত্রেই অভিনয় করেন, তা এতটাই বাস্তবের কাছাকাছি হয় যে প্রশংসা পান সমালোচকদের থেকেও। সাফল্যের আড়ালে প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা আজও অভিনেতাকে নাড়া দেয়।
একসময় স্টুডিওতে ঘুরে বেড়াতে হতো কাজের খোঁজে। সেই দিনগুলোয় তিনি অনেক অপমান আর অভাবের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রথম ছবিতে ছোট্ট চরিত্র পেলেও তাঁর কাছে সেটাই ছিল বিশাল প্রাপ্তি। সেই ছবির শুটিং করতে গিয়ে যে অনুভূতি হয়েছিল, তা তিনি আজও ভুলতে পারেননি। অভিনেতা অকপটে বলেন, “বহুদিন গেছে বিকেল পাঁচটার সময় আমি স্টুডিও পাড়ায় এসে যাঁকেই দেখতে পেতাম, বলতাম যে দাদা একটা কাজ হবে? ছবিটা নিয়ে পেছনে রেখে দিত আর মুখ রাখতে বলতো যে ডেকে নেবো।
এরপর হুট করেই অঞ্জন চৌধুরীর ছবি ‘হীরক জয়ন্তী’তে আমি ডাক পেলাম। জীবনের প্রথম ছবি বলে কথা, সে যতই ছোট চরিত্র হোক। কি ভীষণ উৎসাহ যে রাতে ঘুমাতে পারিনি। সকাল সাতটার আগেই স্টুডিওতে আমি হাজির, কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। তারপর আমায় কোট-টাই পরিয়ে সেটে নিয়ে যাওয়া হল। বলা হলো আমি দর্শক, যে স্টেজের গান শুনবে। সেদিন সারাদিন গান শুনেছিলাম ঠিকই, তবে বুকের ভেতর কান্নাটা চেপে। সেই কষ্ট আজও ভুলতে পারি না।” তারপর আরও একটি ঘটনা তাঁর জীবন ভীষণভাবে বদলে দিয়েছিল।
অভিনেতার কথায়, “তখন সবে ‘আকাশ আটে’ শুরু হলো ‘পুলিশ ফাইলস’। সেই সময় আজকের অনেক বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করতেন তাতে। ‘কসবা থানা রহস্য’ বলে একটি গল্পে আমার বিপরীতে আজকের নাম করা এক অভিনেত্রী ছিলেন। শুটিং করছি, দুপুরে খাওয়ার আর কেউ দিতে আসছে না। আমি বাধ্য হয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতে, সে বলল থালা নিয়ে লাইনে দাঁড়াও। এত অপমানিত বোধ করেছিলাম, সেদিন আর খাইনি। ডিরেক্টর লক্ষ্য করেছিলেন, পরে আমাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে খাবারও খাইয়েছিলেন।
তারপর কেটে গেছে দু’দশকের মত সময়। ‘যমের রাজা দিল বর’ ছবির শুটিং করছি। আমি, আবির আর পায়েল। লাঞ্চ ব্রেকে দরজায় একজন এসে দাঁড়ালেন খাবারের অর্ডার নিতে। তাকিয়ে দেখলাম সেদিনের ওই লোকটি যে আমাকে লাইনে দাঁড়াতে বলেছিল। হেসে বললেন, ভালো আছেন আপনি। অনেক ভালো অভিনয় করেন আরও এগিয়ে যান। আমিও তাকে হাত জোড় করে ভালো থাকার অনুরোধ করেছিলাম। তার কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ, সে অপমানটা না করলে আজ এই জায়গায় পৌঁছাতাম না!”
আরও পড়ুনঃ “সাবিত্রীদি-মাধবীদির মতো অকিঞ্চিতকর চরিত্র আমি করতে পারব না!” “কাজ নেই তাও ঠিক, তবু এতদিনে অর্জন করা সম্মান নষ্ট করবো না!”— স্পষ্ট বার্তা শকুন্তলা বড়ুয়ার! বর্তমান ধারাবাহিকে দুই সহ-অভিনেত্রীর চরিত্র নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি!
একটা সময়ে কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায় পুত্র সন্দীপ রায় নিজের থেকে ফোন করে অভিনেতাকে সুযোগ দিয়েছিলেন ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ ছবির জন্য। সেই থেকে আজও তিনি একের পর এক ছবিতে, ধারাবাহিকে নিজের প্রতিভা প্রমাণ করেছেন। অরুণাভ মনে করেন, জীবনের সেই অপমানই তাঁকে লড়াই করার শক্তি দিয়েছে। তাই আজও তিনি সেই সব মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ, যারা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, সেই অভিজ্ঞতা না থাকলে হয়তো হাল ছেড়ে দিতেন, আজকের অরুণাভ দত্ত হতেনই না।