তাঁকে এক বাক্যে ধরা কঠিন। তিনি কখনও পরিচালক, কখনও অভিনেতা তো কখনও আবার গিটার কাঁধে গান গাওয়া এক নাগরিক, যিনি চারপাশের সমাজকে খুব কাছ থেকে দেখেন। বয়স সত্তর পেরোলেও ‘অঞ্জন দত্ত’র (Anjan Dutt) দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্লান্তি নেই, বরং আছে প্রশ্ন করার জেদ! সময়ের সঙ্গে আপস না করে তিনি বারবার নিজের বিশ্বাস, হতাশা আর ক্ষোভকে খোলাখুলি ভাষায় প্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক এক আলাপচারিতাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেই বক্তব্য যেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসা এক রাজনৈতিক মনন! কী বলেছেন তিনি?
এই বক্তব্যে অঞ্জন দত্ত মূলত ফিরে তাকান বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে। তিনি আজকের ঘটনাগুলোকে আলাদা করে দেখেন না বরং মনে করিয়ে দেন যে, সেইসব সিদ্ধান্তের ফল বহু বছর পর সমাজে ফাটল ধরিয়েছে। ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। এদিন তাঁর কথায় বারবার উঠে এসেছে, কীভাবে ভোটের অঙ্ক কষতে গিয়ে সংস্কৃতির গভীরে আঘাত করা হয়েছে আর সেই আঘাতের রেশ আজও টেনে নিয়ে চলেছে বাংলা!
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “রাজনীতির জন্য সমাজ ধ্বসে পড়ছে, বাংলা ধ্বসে পড়ছে। কিন্তু এটা আজকের নয়, বহুদিন আগের। হঠাৎ করে কিছু বলে, আমি বিশ্বাস করি না। ইংরেজি পড়ানো সরকারি স্কুল থেকে কেন জ্যোতি বসুর আমলে তুলে দেওয়া হলো? যাতে বেশি করে বাংলা শিখি তার জন্য? মোটেই না, ইলেকশনে জেতার জন্য করা হয়েছিল। অনেক বড় ভুল ছিল ওটা! সংস্কৃতির অবমাননা এটা! একটা সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ রাজ্য, যেখানে শুধু বোস-ঘোষ-দস্তিদার থাকে না! এখানে অ্যাঙ্গলোরা থাকে, পর্তুগিজরা থাকে।
বিহারীও আছে, পাঞ্জাবিও আছে, মাড়োয়ারিও আছে। বলতে পারবেন, কলকাতায় মাড়োয়ারিদের কন্ট্রিবিউশন নেই? কলকাতাটা কি একা একাই তৈরি হয়ে গেল? হঠাৎ করে রাস্তার নাম পাল্টে দেওয়া, মাদার তেরেসা সরণি করে দেওয়া। এগুলো তো অনেক আগে থেকেই হচ্ছে। ব্রিটিশ আমলের সব ভালো ভালো স্ট্যাচু ব্যারাকপুরে ফেলে দিয়ে, কুৎসিত দেখতে একটা অরবিন্দ স্ট্যাচু কেন আনা হয়েছে? তাতে কি আমাদের জাতীয়তাবাদ বেড়েছে? বাংলার রাজনৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে আমি কখনওই খুশি ছিলাম না।
সমস্ত ইতিহাস বিকৃত করে দিচ্ছে এরা। এই মুহূর্তে কেন, সব থেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে বাংলার জ্যোতি বসুর আমলেই! আজ কলকাতায় প্রত্যেকটা বড় বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং কোম্পানি কেন উঠে গেল? কেন কলকাতা ছেড়ে দিয়ে মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর চলে গেল তারা? লাগাতার ধর্মঘট করে করে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল! এভাবে কি বেশিদিন চলে?” এই বক্তব্যে আবেগ আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর যুক্তি। অঞ্জন দত্ত কলকাতার বহুত্ববাদী চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ ‘মিঠুনদা যাকে ধরবে কাঁদিয়ে ছেড়ে দেবে, আজও কিছু দৃশ্য মনে পড়লে শিউরে উঠি!’ ‘ওনার সঙ্গে কাজ মানে শরীর ও মনকেও প্রস্তুত রাখতে হয়’ অ্যাকশন দৃশ্যে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার স্মৃতি ভাগ করলেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়!
যেখানে নানান ভাষা ও সম্প্রদায় মিলেমিশে শহরটাকে গড়ে তুলেছে। তাঁর চোখে, ইতিহাসকে নিজের সুবিধেমতো বদলে নেওয়া কিংবা প্রতীকী সিদ্ধান্তে জাতীয়তাবাদ জাহির করার চেষ্টা আসলে শিকড়কে দুর্বল করেছে। শিল্প, বাণিজ্য আর সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে কলকাতার যে অবস্থান ছিল, তা ধীরে ধীরে কেন সরে গেল এই প্রশ্নও তিনি তুলেছেন সরাসরি। তাঁর এই বক্তব্য কোনও তাৎক্ষণিক রাগের বিস্ফোরণ নয় বরং এক নাগরিক শিল্পীর দীর্ঘদিনের হতাশার দলিল। অঞ্জন দত্ত এখানে কাউকে তোষামোদ করেননি, আবার অকারণ নাটকীয়তাও নেই।






