‘ঘনা’দার যে ছবিটি পাঠকদের মনে গেঁথে সেটি আমার বাবার সৃষ্টি! নগণ্য ছবি আঁকাতেও পি সি সরকার আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকতেন,বলতেন নিজের কাজটা করানোর জন্য, ব্যস্ততম মানুষের কাছেই যেতে হয়, যার হাত ফাঁকা, সে কাজটা পারে না!’ চিরঞ্জিত চক্রবর্তী

বাংলার শিল্পী জগতে ‘শৈল চক্রবর্তী’ (Shailo Chakraborty) ছিলেন এক অনন্য মানুষ, যাঁর কাছে সৃজনশীলতা ছিল যেন ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা। কারও কাছে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ কার্টুনিস্ট, কারও কাছে ইলাস্ট্রেটর, আবার অনেকের চোখে আধুনিক পাপেট্রির জনক। তবে মানুষটির আরও একটি পরিচয়, তিনি অভিনেতা ‘চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী’র (Chiranjeet Chakraborty) বাবা। বন্ধুবান্ধবদের বাবারা যেখানে নিখুঁত নিয়মে জীবন চালাতেন, সেখানে অভিনেতার বাবা ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। স্বল্পমূল্যের শিল্পী হিসেবে সারাজীবন কাটিয়েছেন, অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও কষ্ট করতে দেননি অভিনেতাকে।

হাওড়ার সাধারণ এক পরিবারে জন্ম হলেও, অভিনেতার বাবার কখনওই গতানুগতিক ধারার পেশায় যুক্ত হতে চাননি। সিটি কলেজ থেকে অঙ্কে অনার্স করার পর পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রসাধন তৈরির কাজ। বাড়ির মধ্যেই বানিয়ে ফেলেছিলেন ছোট কারখানা— যেখানে তৈরি হত আলতা, সিঁদুর, সাবান। কিন্তু ব্যবসা সেভাবে জমেনি। ঠিক সেই সময়েই বিজ্ঞাপনের জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, আর সেই সূত্রেই শিল্পী হিসেবে নতুন দিগন্ত খুলে যায়। যদিও কোনও দিনই আঁকা নিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা করেননি, কিন্তু তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।

প্রসঙ্গত, ১৯৩০-এর দশকে তিনি শুরু করেন পত্রপত্রিকায় ইলাস্ট্রেশন আঁকা। ধীরে ধীরে তাঁর আঁকার গুণে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী। কমিক ছবির জগতে শৈল চক্রবর্তীর অবদান আজও অমলিন। ‘ঘনাদা’র যে চেহারাটি আজও পাঠকের মনে গেঁথে আছে, সেটি তাঁরই সৃষ্ট। তবু, তিনি কখনও নিজেকে প্রচারে আনেননি। সম্প্রতি চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী বাবার সঙ্গে জাদু দুনিয়ার কিংবদন্তি পি সি সরকারের সম্পর্কে এমন একটা ঘটনা তুলে ধরলেন, যা অনেকের কাছেই শিক্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। যে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাদুকর পি সি সরকার (সিনিয়র)-এর ইন্দ্রজালে কাবু গোটা দুনিয়া,

সেই তিনিই কিনা শৈল চক্রবর্তীর কাছে কয়েকটা অত্যন্ত নগণ্য ছবি আঁকানোর জন্য দিন রাত তার বাড়িতেই পড়ে থাকতেন! এদিন চিরঞ্জিৎ জানালেন, “সেই সময় বাবার হয়ে প্রচুর কাজ। পুজোর সংখ্যায় আঁকা, পত্র পত্রিকায় ছড়াছড়ি। কিন্তু পি সি সরকারকে দেখতাম তাও বাবার কাছে ওই কয়েকটা জাদুর ছবি আঁকতে আসতেন, বিদেশি পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করবেন বলে। বাবা বিরক্ত হয়ে একদিন বলেই বসলেন, এই আঁকা তো আর্ট কলেজের ছাত্ররাও আঁকতে পারে, কম মূল্যে! তাহলে শৈল চক্রবর্তীর কাছে আসা কেন?

আরও পড়ুনঃ “ওই যে লম্বা দাড়ি ছিল যে ঠাকুরের, কবিতা লিখতেন…তাঁর থেকেই শিখেছি, কিভাবে প্রবীণদের সঙ্গে কম আর নবীনদের সঙ্গে বেশি মেশা যায়”, “ওদের কাছেই শেখার আছে অনেক কিছু”— তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অকপট পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়!

সেদিন পি সি সরকারের উত্তরটা আজও কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, ‘নিজের কাজটা ঠিকমত করানোর জন্য, সব সময় ব্যস্ততম মানুষের কাছেই যেতে হয়। যাঁর হাত ফাঁকা, অনেক সময়– সে কাজটা পারে না!’ এই কথাটার মূল্য কোনদিনও কম হবে না।” চিরঞ্জিৎ বলেন, পি সি সরকারের এই বক্তব্য শুধু একজন শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নয়, বরং কাজের মানসিকতার এক গভীর শিক্ষা। পি সি সরকার ও শৈল চক্রবর্তীর মতো মানুষ হয়তো আজ বিরল, কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা, তাঁর অধ্যবসায় এবং তাঁর শিল্পবোধ আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রেরণা জোগায়।