“জীবন থেকেই তো সিনেমা, আর আমার জীবনটাও একেবারে সিনেমার মতো।”— শাশুড়ির চোখে ছিলেন ‘খারাপ লাইনের মেয়ে’! সন্তান জন্ম দিলে হয়তো মা বাঁচতেন না! মৌসুমী সাহার নীরব লড়াইয়ের গল্প চোখে জল আনবে আপনার!

অভিনয় জগতে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তরুণ মজুমদারের ‘আপন আমার আপন’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়াই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। তবে ‘মৌসুমী সাহা’র (Moushumi Saha) নাম ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় ‘জন্মভূমি’ (Janmabhumi) ধারাবাহিক। প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে এই ধারাবাহিকে কাজ করে তিনি একেবারে বাঙালি দর্শকের মনে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে ফেলেছিলেন। আজও সেই অবস্থান অটুট। সহজাত অভিনয় দক্ষতা জন্যই হয়তো তাঁকে কেউ ভুলতে পারেন না। তিনি থেমে যাননি। সময়ের সঙ্গে লড়াই করে আজও পর্দায় তিনি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

জীবনের উত্থান-পতনের ছাপ পড়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বে, আর সেই অভিজ্ঞতার গন্ধই মেলে তাঁর সংলাপে। মৌসুমীর নিজের কথায়, “জীবন থেকেই তো সিনেমা, আর আমার জীবনটাও একেবারে সিনেমার মতো।” ব্যক্তিজীবনে মৌসুমীর এক ছিমছাম সুখের সংসার। শোভাবাজার থাকেন স্বামীর সাথে, তিনি পেশায় ওয়াইনের ব্যবসায়ী। তবে মজার বিষয়, অভিনয়পাগল এই অভিনেত্রী কখনও এক ফোঁটা ওয়াইনও চেখে দেখেননি। স্বামী না থাকলে রাতে আলো নিভিয়ে ঘুমোতে পারেন না, কারণ ভূতের ভয় তাঁর, সঙ্গে মানুষকে এবং একাকিত্বেও ভয় পান তিনি।

মুখে এক, মনে আর এক এমন মানুষদের তিনি সহ্য করতে পারেন না। তাঁর মতে, সম্পর্কের মূলে থাকা উচিত ‘ওয়েভলেন্থ’— যার সঙ্গে মানসিক মেলবন্ধন হয়, সেই-ই হতে পারে বন্ধু। অথচ এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর, বলে আক্ষেপ অভিনেত্রীর। তবু তাঁর বিশ্বাস, নিজেকে লুকিয়ে নয়, খোলামেলা মনেই টিকে থাকে আসল সম্পর্ক। তিনিও তাই নিজের মতো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। আজও বাসে-ট্রামে যাতায়াত করেন, মেট্রো চড়েন। স্টারডম তাঁকে ছুঁতে পারেনি। মৌসুমীর শিকড়ে রয়েছে এক রক্ষণশীল পরিবার।

যেখানে মা চেয়েছিলেন মেয়েরা পড়াশোনা, নাচ-গান আর অভিনয়ে দক্ষ হয়ে উঠুক, উৎসাহ ছিল পরিপূর্ণ। কিন্তু বিয়ের পর শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। প্রেম করে বিয়ে করলেও, শাশুড়ির কাছে অভিনেত্রী বৌমার ভাবমূর্তি ছিল একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। অভিনয়ের উপর চাপ এসেছিল, থিয়েটার থেকেও সরে যেতে হয়েছিল সাময়িকভাবে। তবু হাল ছাড়েননি মৌসুমী। শাশুড়িকে লুকিয়ে নাটক করতেন, মায়ের কাছে যাচ্ছেন বলে বেরিয়ে যেতেন, ফিরে এসে বলতেন বাপের বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছেন।

এমন সময়ও গেছে, যখন তিনি মঞ্চে ঘোমটা টেনে অভিনয় করেছেন, শুধু শাশুড়ির অপছন্দ এড়িয়ে চলার জন্য। স্বামী পাশে ছিলেন বলেই সেই লড়াই সম্ভব হয়েছিল। ‘জন্মভূমি’ সিরিয়ালে তাঁর কাজ যখন মানুষের ভালোবাসা পেতে শুরু করল, তখন শাশুড়ির মনেও গলল বরফ। আর একদিন যখন তিনি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেলেন, শাশুড়িকে পাশে নিয়েই মঞ্চে উঠেছিলেন। অভিনয় যে ‘খারাপ লাইন’ নয়, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের অর্জনের মাধ্যমেই। মৌসুমী সাহা কখনও নিজের সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি।

একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার পর ডাক্তার জানিয়ে দেন যে গর্ভধারণ করলে মা অথবা সন্তান, কেউ একজনই বাঁচবে। স্বামী তখনও তাঁকে কোনও মানসিক চাপে ফেলেননি। সন্তান না থাকলেও, মনের অভাব হয়নি। পরিচিত এক অবাঙালি বাচ্চাকে সন্তান স্নেহে বড় করে তুলেছেন তিনি। সেই ছেলের বিয়েও দিয়েছেন, তাঁর সন্তানরা মৌসুমীকে ‘দাদি’ বলে ডাকে। মৌসুমী স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সমস্ত সম্পত্তি সেই ছেলের কাছেই থাকবে। বাস্তবে না হোক, পর্দায় তিনি হিরোদের মা হয়ে উঠেছেন।

আরও পড়ুনঃ জলসার ভয়ে ভীত জি বাংলা? অনিশ্চয়তার মুখে জি বাংলা ‘রাণী ভবানী!’ কোনদিনই আসবে না এই ধারাবাহিক?

জিৎ, দেব, অঙ্কুশ, সকলেই তাঁদের কেরিয়ারের প্রথম ছবিতে মা হিসেবে মৌসুমীর চড় খেয়েছেন। আর সেই থেকেই শুরু তাঁদের সাফল্যের। তাই মৌসুমী বলেন, “ওরাও তো আমার ছেলে, আমার খুব আপন।” মৌসুমী সাহা কেবল একজন অভিনেত্রী নন, তিনি এক সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। যিনি অভিনয় ভালোবেসে জীবনের প্রতিটি লড়াইকে সযত্নে জয় করেছেন। শিকড়কে আঁকড়ে রেখে, নিজের মতো করে বাঁচার সাহসই তাঁকে সত্যিকারের স্টার করে তুলেছে।