কিছুদিন ধরে ফুসফুসের অ্যাডেনোকার্সিনোমা এবং শরীরে ছড়িয়ে পড়া ক্যা’ন্সারে ভুগছিলেন অভিনেত্রী ‘শ্রাবণী বণিক’ (Sraboni Banik)। গত সোমবার, পরলোক গমন করেছেন তিনি। অভিনেত্রীর প্রয়াণের খবরে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এল তাঁর দীর্ঘ অসুখ এবং আর্থিক টানাপোড়েন। এসবই সত্যিই বাস্তব এবং বেদনাদায়ক, কিন্তু সেই আলোচনার ভিড়ে একটু আড়ালেই থেকে গেল তাঁর অভিনয়জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়টি! হ্যাঁ, তিনি শুধুই একজন ধারাবাহিকের বিশিষ্ট অভিনেত্রী ছিলেন না, কিংবা কেবল অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করা এক শিল্পীও নন।
বাংলা ছবির ইতিহাসে তিনি থেকে যাবেন তরুণ মজুমদারের হাতে তৈরি শেষ অভিনেত্রী হিসেবে! অনেকেই জানেন না, তরুণ মজুমদারের ছবিতে শ্রাবণীর যাত্রা শুরু হয়েছিল নায়িকা হয়ে নয়! বরং এমন এক চরিত্রে, যা গল্পের ভিত শক্ত করে দিয়েছিল। অন্যতম জনপ্রিয় সেই ‘আলো’ ছবির গ্রামের এক সাহসী নারী, ‘মোতি’ চরিত্র দিয়েই বড় পর্দায় তাঁর পরিচিতি। ছবিটা যে শুধু পরিচালকের প্রত্যাবর্তন ছিল সেটা কিন্তু না, অনেক অভিনেতার কাছেই ছিল নতুন সুযোগ! আজও ‘আলো’র কথা উঠলে, শ্রাবণীর উপস্থিতি আলাদা করে মনে পড়ে।
এরপরেই ধীরে ধীরে তরুণ মজুমদারের ছবিতে তিনি উঠে আসেন মুখ্য ভূমিকায়। কখনও নায়িকার কাছাকাছি তো আবার কখনও সমান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। তবে সত্যিটা এটাই, শ্রাবণী কখনও সেই অর্থে জনপ্রিয় নায়িকার জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। তাঁর অভিনয়ে আন্তরিকতা ছিল, কিন্তু বাণিজ্যিক ছবির যে জৌলুস বা তারকাসুলভ আকর্ষণ লাগে, তা তাঁর মধ্যে ছিল না। ছোটপর্দায় ২০১৪তে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বা পরবর্তী ছবিগুলি দর্শক টানতে পারেনি, তার দায় একা তাঁর নয়!
সময়, কাস্টিং আর পরিচালনার দুর্বলতাও সেখানে কাজ করেছে। তবু তরুণ মজুমদার তাঁকে বারবার সুযোগ দিয়েছেন, বিশ্বাস রেখেছেন। এই বিশ্বাসটাই ছিল তাঁদের সম্পর্কের মূল ভিত। যেখানে শুধু শিল্পী নয়, দুই কমরেডেও ছিলেন তাঁরা। প্রসঙ্গত, ক্যামেরার বাইরের শ্রাবণী ছিলেন আরও দৃঢ়, আরও নীরব। রাজনীতির প্রশ্নে তিনি আপস করেননি, সুবিধের পথ নেননি। ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকার জন্য দলে দলে নাম লেখানোর খেলায় তিনি যাননি বলেই হয়তো কাজের সুযোগ ক্রমশ কমেছে।
তরুণ মজুমদারের জীবনের শেষ পর্বে যেভাবে তিনি পাশে ছিলেন, যত্নে আগলে রেখেছিলেন। পরিচালকের স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে, শ্রাবণকেই দোষী করা হয়েছিল। যদিও তিনিই সেই সময় পরিচালকের জীবনে ছিল না, তাও কলঙ্ক সঙ্গী হয়েছিল তাঁর। একটা সময় পরিচালকের ‘বিশেষ সঙ্গিনী’ হিসেবে দাগ লাগে! পরবর্তীতে পরিচালকের কাজকর্মের নথি-স্মৃতি সংরক্ষণে দায়িত্বগুলোও তিনিই সামলেছেন বছরের পর বছর।
আরও পড়ুনঃ নিজের দু’ষ্টু ছবি পাঠিয়ে টলি পাড়ার নামী প্রযোজককে নিজের জালে তোলার চেষ্টা করলেন জনপ্রিয় নায়িকা! কাজে দিল দুষ্টু পরিকল্পনা? নাকি পড়লেন বিপাকে?
আজ শ্রাবণী বণিক নেই। তাঁর অভিনয়জীবন নিখুঁত ছিল না, সাফল্যের রেখা মসৃণও ছিল না। তবু একটি অধ্যায় তাঁর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল, তরুণ মজুমদারের ছবির শেষ উত্তরাধিকার বহনকারী অধ্যায়! বাংলা ছবির ইতিহাসে এই জায়গাটা ছোট নয়। হয়তো ভবিষ্যতে তাঁর কাজ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, তিনি ছিলেন সেই শেষ শিল্পী, যাঁর হাত ধরে তরুণ মজুমদার নতুন করে কাউকে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এই পরিচয়টাই শ্রাবণী বণিকের সবচেয়ে স্থায়ী ছাপ হয়ে থেকে যাবে।






