আজ থেকে ১২ বছর আগে ৩ জানুয়ারি প্রয়াত হন সংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র। আর এদিন মঙ্গলবার ৩ জানুয়ারি সকালে পরলোক গমন করলেন ৮৯ বছরের সঙ্গীতশিল্পী সুমিত্রা সেন। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যের নানা সমস্যায় ভুগছিলেন প্রবীণ শিল্পী। আজ অর্থাত্ মঙ্গলবার ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মায়ের মৃত্যুর খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান মেয়ে শ্রাবণী সেন। যদিও শিল্পী তাঁর গানের মাধ্যমে এখনও আমাদের মনে অমর হয়ে আছেন। জানা গিয়েছে, আজ ভোর ৪টে নাগাদ সুমিত্রা সেন হৃদরোগে আক্রান্ত হন। শেষের দিকে কিডনি ফেল করে যায়। গতকাল তাঁকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনা হয় বলে জানা গিয়েছে। গত ২১ ডিসেম্বর সুমিত্রা সেনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মার্চেই নব্বই বছরে পা রাখতেন সুমিত্রা সেন। কিন্তু তা আর হল না, শিল্পীর প্রয়াণে শোকাহত গোটা সঙ্গীতজগৎ। তবে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত শ্রোতাদের কাছে চির সম্পদ। তিনি বুঝিয়েছে, সংসারী হয়েও পেশাদারি হওয়া অসম্ভবের কিছু নয়। তাই বহুজনের মতে, ‘পেশাদার’ হতে গেলে অনেক ‘ত্যাগ’ করতে হয়- এই কথাটা হয়তো মেনে নেওয়া যায় না। পেশাদারির সাথে সাথে সুন্দরভাবে সংসার করে গেছেন সংগীতশিল্পী সুমিত্রা সেন। স্বামী, দুই কন্যা, নিজের চাকরি সামলেই তাঁর অসাধারণ কণ্ঠের গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র কিংবা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গান করেছিলেন তিনি।
১৯৫১ সালে কুমারী সুমিত্রা দাশগুপ্ত নামে প্রথমে দু’টি নজরুলগীতি (‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’, ‘বেদনার বেদী তলে’) রেকর্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অনন্য এই শিল্পী। তাঁর গলায় নজরুলগীতি ছাড়াও পল্লিগীতি (জিপসিগান, ধামাইলগান, পালাগান, বিয়েরগান), আধুনিকেরও রেকর্ড রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এই গানগুলোর প্রতি জাস্টিস করতে পারিনি।’’ – তাঁর এরূপ উক্তি যেন প্রকৃত শিল্পীমনের চিরকালীন অতৃপ্তির কথা প্রকাশ করছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই সংগীতশিল্পী সুমিত্রা সেন-এর অধিক পরিচিতি। তাঁর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন দেড়শোরও বেশি। পাশাপাশি ষোলোটি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্লে-ব্যাক করেছেন। যার শুরু হয়েছে উত্তমকুমারের অনুরোধে ১৯৬০ সালে ‘শুন বরনারী’ ছবির গানের মাধ্যমে। শ্রোতাদের কাছে তাঁর এক স্মরণীয় শিল্পী হিসাবে পরিচিতি। আর তাই তাঁর জীবনের ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের রেকর্ড না থাকাটা সঙ্গীতজগতের অপূরণীয় ক্ষতি।
সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘শ্যামা’, ‘শাপমোচন’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘বর্ষামঙ্গল’, ‘বসন্ত’ বা ‘মায়ার খেলা’ (পরিচালনা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)-র মতো নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যে গান তাঁকে সকলের কাছে স্মরণীয় করে তুলেছে। উস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, রবীন চট্টোপাধ্যায়, ভি বালসারা, তিমির বরণ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সতীর্থ এবং সহপাঠী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘কোমল গান্ধার’- ছবির সঙ্গীত পরিচালক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে বলেছিলেন ছবিতে সুমিত্রার কণ্ঠ ব্যবহার করার জন্য।
সংসার, নিজস্ব কাজ, গান নিয়ে ব্যস্ত শিল্পী রাজনীতি থেকে চিরকাল দূরে থাকা পছন্দ করেছেন। আর তার জন্যই হয়তো সুমিত্রার নিজ রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কিছু কম। যা নিয়ে বেশ আক্ষেপ ছিল প্রবীণ শিল্পীর। তাঁর এই আক্ষেপ ফুটে উঠেছিল উক্ত তাঁর নিজের কথাতেই , ‘‘ইন্ডাস্ট্রি হয়তো আমার কণ্ঠ আরও একটু বেশি ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু কেন হয়নি, তা জানি না। রেকর্ডগুলো তো বিক্রি হতো…। তা হলে?’’