গান গাইতে গাইতে কেঁদে ফেলেছিলেন মান্না দে! কোন ঘটনার আবেগে ভেঙে পড়েছিলেন এই কিংবদন্তি গায়ক?

গান শুনে কাঁদা যায়? কেউ যদি একথা বলে, অনেকেই হাসবেন। কিন্তু যারা মান্না দে-র গান শুনেছেন, তারা জানেন—একটা গানের মধ্যে কতটা অনুভব লুকিয়ে থাকতে পারে। সন্ধ্যেবেলায় রেডিওতে হঠাৎ ভেসে ওঠা “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা” অথবা “আয় ফিরে আয়”—এমন হাজারো গান ছিল, যা নিছক গান নয়, জীবনের একটা পর্ব মনে হত।

এমন শিল্পী ছিলেন মান্না দে, যিনি সুরে সুরে ছুঁয়ে যেতেন মনের গভীরতম কোণ। তাঁর গলার মধ্যে ছিল না কোনও জাঁকজমক, ছিল না বাহুল্য। তবু সেই সরলতায় ছিল অপার আকর্ষণ। ছোটবেলায় সংগীতের প্রতি যে প্রেম জন্ম নিয়েছিল, তা বড় হয়ে রূপ নিয়েছিল সাধনায়। আর সেই সাধনার প্রথম প্রেরণা ছিলেন তাঁর কাকা, কৃষ্ণচন্দ্র দে। তাঁর হাত ধরেই মাত্র ২৩ বছর বয়সে মান্না দে পাড়ি দেন মুম্বই, ১৯৪২ সালে।

মান্না দে কেবলমাত্র প্রেম কিংবা ভক্তির গানেই থেমে থাকেননি। জীবনযুদ্ধ, প্রতিবাদ, এমনকি দুঃখের স্মৃতিকেও তুলে ধরেছেন গানে। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার ফুটবল মাঠে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা এখনও অনেকের মনে জেগে আছে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলার দিন পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১৬ জন ফুটবলপ্রেমীর। সেই ঘটনার ঠিক একবছর পর, ১৯৮১ সালে রেকর্ড হয় এক ঐতিহাসিক গান—”খেলা ফুটবল খেলা”।
এই গানটির জন্ম এক গভীর আবেগঘন পরিবেশে। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন কবিতা, গানটি সুর করেন সুপর্ণকান্তি ঘোষ, আর কণ্ঠ দেন মান্না দে। গানটির রেকর্ডিং হচ্ছিল ‘টাকার ফানুস’ ছবির জন্য। উপস্থিত ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ কুমার সহ একঝাঁক গুণীজন।

গান যখন শুধু গলা দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে গাওয়া হয়, তখন সেটা আর গান থাকে না—রূপ নেয় এক আন্দোলনে। ঠিক এমনটাই হয়েছিল “খেলা ফুটবল খেলা”-র ক্ষেত্রে। কবিতার একটি অংশ—‘খোকা বলে’—গাইতে গিয়ে বারবার আবেগে ভেঙে পড়েছিলেন মান্না দে। স্টুডিওর সবাই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অনেকে বলেছিলেন, এই আবেগপূর্ণ গলাটুকু রেখে দেওয়া হোক গানে। কিন্তু মান্না দে স্পষ্ট বলেন, “গায়কের আবেগ কতটা থাকবে, সেটার একটা মাপকাঠি থাকা উচিত। বেশি হলে গানটাই মাটি হতে পারে।”

সেই সময়ে তিনি চোখ মুছতে মুছতেই আবার সুর ধরেছেন। এমন পেশাদারিত্ব আর আবেগের মিশেল আজকের দিনে বিরল। আর এভাবেই তৈরি হয়েছিল এমন একটি গান, যা কেবলমাত্র সংগীত নয়, এক ঐতিহাসিক নথি হয়ে রয়েছে কলকাতার ট্র্যাজেডি এবং আবেগের।

আরও পড়ুনঃ ইচ্ছাকৃতভাবে ওই বৃদ্ধকে পিষে মে’রে’ছেন পরিচালক ভিক্টো! অনিচ্ছাকৃত খু’নের মামলা খারিজ করে ইচ্ছাকৃত খুনের মামলা জারি পুলিশের!

চার হাজারের বেশি গান গাওয়া এই কিংবদন্তি শিল্পীর গানের মধ্যে পাওয়া যায় জীবনের প্রতিটি রং। “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল” থেকে “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা”—যে গানেই হাত দিয়েছেন, হয়ে উঠেছে কালজয়ী। একেকটা গান যেন একেকটা সময়ের দলিল। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর, দুপুর ৩টা ৪৫ মিনিটে বেঙ্গালুরুর নারায়ণা হসপিটালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। কিন্তু তিনি আমাদের ছেড়ে কোথায় যান! তাঁর গাওয়া প্রতিটি সুরেই তো তিনি থেকে গেছেন আমাদের মনের ভিতর। গান যখন আবেগ ছুঁয়ে যায়, তখন মান্না দে-র গলা যেন এখনও বাজে—ধীরে, গভীরভাবে।