জি বাংলার অনন্যা নয়, দূরদর্শনের সুমিত্রা ছিলেন প্রথম ‘সুবর্ণলতা’! মাধবী মুখোপাধ্যায়ের চোখেও সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ই ছিলেন ‘জীবন্ত সুবর্ণলতা’! — অভিনেত্রীর প্রয়াণ মাসে ফিরে দেখা সেই কালজয়ী অধ্যায়!

আজ নতুন প্রজন্ম ‘অনন্যা চট্টোপাধ্যায়’কে (Ananya Chatterjee) টেলিভিশনের ‘সুবর্ণলতা’ হিসেবে চেনেন, কিন্তু ক’জন জেনে ১৯৮৭ সালে দূরদর্শনে ‘সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়’কে (Sumitra Mukherjee) নিয়ে সেই কালজয়ী নির্মাণ? নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন বাংলা ধারাবাহিক টেলিভিশনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে, তখনই এক অনন্য সৃষ্টি নিয়ে হাজির হলেন পরিচালক রাজা সেন। আশাপূর্ণা দেবীর কালজয়ী উপন্যাস ‘সুবর্ণলতা’ (Subarnalata) অবলম্বনে তৈরি সেই ধারাবাহিক আজও বাঙালির স্মৃতিতে অম্লান। সাদাকালো টেলিভিশনের যুগে এই রঙিন ধারাবাহিক শুধুই বিনোদনের ছিল না, বরং সামাজিক প্রতিবাদের নিঃশব্দ ভাষ্য হয়ে উঠেছিল।

রাজা সেনের ‘সুবর্ণলতা’তে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অসাধারণ অভিনেত্রী সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, যাঁর অনবদ্য অভিনয়ে সুবর্ণলতা হয়ে উঠেছিল প্রতিটি মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর আত্মপ্রতিচ্ছবি। এটি শুধু একটি সাহিত্যর রূপান্তর ছিল না, বরং ছিল এক রকমের আবেগ। ১৯৮৬ সালে শুরু হয় শ্যুটিং, ১৯৮৭ সালে প্রথম সম্প্রচারিত হয় এটি কলকাতা দূরদর্শনে। ততদিনে সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী জীবিত, আর তাঁর সম্মতি নিয়েই চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়।

মাত্র ১৪ পর্বের এই ধারাবাহিক তবুও দর্শকদের মনে গেঁথে যায় চিরস্থায়ীভাবে। প্রতি সপ্তাহে একবার করে সম্প্রচারিত পর্বের জন্য দর্শকরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। পরিবারতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভেতর এক প্রতিবাদী নারীর ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা আর জেদকে সামনে এনে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় সেসময় শুধু প্রশংসাই কুড়োয়নি, জয় করে নিয়েছিল বিভিন্ন টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ডও।কিছুদিন আগেই গিয়েছে সুমিত্রা দেবীর প্রয়াণ দিবস।

এদিন পরিচালক রাজা সেন স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানান, তিনি সুমিত্রাদিকে ভেবেই এই চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন। হাসিদি অর্থাৎ সুমিত্রা, যেমন পর্দায় সাবলীল তেমনই ছিলেন অফ ক্যামেরাও। কোনোদিন ব্যক্তিগত সমস্যা কাজের মাঝে নিয়ে আসেননি। বোলপুরে আউটডোরে একটি সূর্যাস্তের দৃশ্যের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, দৃশ্যটির জন্য সবাইকে বিনা পারিশ্রমিকে আবারও শ্যুট করতে রাজি করান সুমিত্রা নিজে।

এমন নিষ্ঠা, কাজের প্রতি ভালোবাসার ছাপ রেখে গিয়েছিলেন তিনি, যা আজকের সময়ে কল্পনাও করা যায় না। অভিনেত্রী পাপিয়া সেন, যিনি ছিলেন ‘সেজ বউ’ চরিত্রে, তিনিও ভাগ করেছেন স্মৃতি। প্রথমে অনেকটাই নার্ভাস ছিলেন এই বিশাল অভিজ্ঞ টিমের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে। তবে খুব দ্রুত সবাই তাঁকে আপন করে নেন, বিশেষত সুমিত্রা। তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মজার কিছু ঘটনা, তেমনই শ্যুটিংয়ের সময় আন্তরিক পরিবেশের কথাও উঠে আসে।

স্টুডিওর সেটে গীতা দে, চিত্রা সেন, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় একসঙ্গে রান্না করতেন, আর সেই রান্না খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন গোটা ইউনিট। আজকের প্রফেশনাল পরিবেশে যা ভাবনারও অতীত! ‘সুবর্ণলতা’ ধারাবাহিকে ছিলেন আরও একঝাঁক অসামান্য অভিনেতা-অভিনেত্রী, যেমন বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, গীতা দে, চিত্রা সেন, ঋতা দত্ত চক্রবর্তী, অনসূয়া মজুমদার প্রমুখ। গীতা দে-র শাশুড়ি চরিত্র কিংবা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণলতার স্বামীর চরিত্র আজও দর্শকের মনে জায়গা করে আছে।

আরও পড়ুনঃ ‘ছোট বউ’র ‘দজ্জাল শাশুড়ি’র আড়ালেই হারিয়ে গেল এক প্রতিভাবান নারীর ইতিহাস! অভিনয়ে ছিলেন শক্তিশালী, নৃত্যে ছিলেন অসামান্য! অথচ বাংলা তাঁকে ভুলে গেল! কে ছিলেন আসলে মীনাক্ষী গোস্বামী?

ধারাবাহিকের এমন সফলতায় একদিন নিজে থেকেই সেটে হাজির হন মাধবী মুখোপাধ্যায়। সুমিত্রাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলে ওঠেন, “হাসি, তুই তো আমার থেকেও ভালো সুবর্ণলতা করছিস!” এই ধারাবাহিক শুধুই এক নারীর কাহিনি নয়, এটি ছিল এক যুগের দলিল, যেখানে প্রতিটি সংলাপে মিশে ছিল সেই সময়ের সমাজের বাস্তবতা, প্রতিবাদ এবং পরিবর্তনের আকুতি। আর এই ইতিহাসের কেন্দ্রে ছিলেন সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, এক নারী, এক শিল্পী সবচেয়ে আগে এক কিংবদন্তি!