বাংলা চলচ্চিত্রের ‘লক্ষ্মী’র নিঃসঙ্গ বিদায়! রবি ঘোষের স্ত্রী থেকে বাংলার বিস্মৃত নায়িকা, নামের মতোই হঠাৎ বদলে যায় জীবন! ১৬ তে অভিনয় শুরু, ৪২-এই জীবন শেষ অনুভা গুপ্তর! অভিনেত্রীর মৃত্যু আজও এক রহস্য টলিউডে!

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘লক্ষ্মী’ তথা এক বিস্মৃত প্রতিভা ‘অনুভা গুপ্ত’ (Anubha Gupta) , যাঁর আসল নাম ছিল ‘মৃদুলা’ এবং পিতা-মাতা– রমেশচন্দ্র গুপ্ত, আভা গুপ্ত। অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলার এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে হয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন রূপালি পর্দার এক উজ্জ্বল মুখ। মৃদুলার শৈশব কেটেছে লেখাপড়া, গান, নাচ এবং শরীরচর্চার মধ্যে। শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে পড়ার সময় থেকেই তাঁর শিল্পচর্চার ভিত তৈরি হয়। সেখানকার শিক্ষা তাঁকে সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ করে তোলে। ভবানীচরণ দাসের কাছে সংগীত শিক্ষা এবং বঙ্গীয় কলালয়ে নৃত্যচর্চা ছিল তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রস্তুতি পর্ব।

মাত্র পনেরো বছর বয়সে থিয়েটারে অভিনয় শুরু হলেও, রূপালি পর্দার দরজা খুলে যায় এক অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে। মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে গিয়ে সেখানকার গ্যালারি থেকেই তাঁকে দেখে ফেলেন প্রযোজক-পরিচালক — রবীন চট্টোপাধ্যায়, শিশির মল্লিক এবং খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায়।। তাঁদের চোখে মৃদুলার সরল সৌন্দর্য এবং স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ ছিল এক নতুন নায়িকার খোঁজের সমাপ্তি। এইভাবেই ‘সমর্পণ’ ছবির নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। যদিও প্রথমে সিনেমায় অভিনয় করাটা ছিল তাঁর কাছে অবিশ্বাস্য।

শেষমেশ মায়ের ‘আভা’ নামকে সম্মান জানিয়ে ‘অনুভা’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে। অনুভার অভিনয় জীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৪০-এর দশকে। কেরিয়ারের এই দীর্ঘ পথে তিনি শুধু নায়িকা হিসেবে নয়, চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেও নানা ধরণের ভূমিকায় অনন্য হয়ে উঠেছিলেন। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র মতো কালজয়ী ছবিতে অভিনয় করে তিনি নিজের জাত চিনিয়ে দেন। এই সময়েই অভিনেতা রবি ঘোষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও পরে বিয়ে হয়।

তবে এই সম্পর্কও শেষ পর্যন্ত সুখকর হয়নি। প্রিয় বান্ধবী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কথায়, অনিল দে নানান রকম অত্যাচার করতেন অনুভার উপরে। রবি ঘোষের সঙ্গে বিবাহের পরেও চেষ্টা করেছেন কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। ধাওয়া করেছেন নানান জায়গায়, অনুভার হদিশ পেতে। এরপর অবশ্য বাংলা চলচ্চিত্রের লক্ষ্মীর শেষ জীবনটা বড়ই নির্মম। সম্পর্কের মানসিক যন্ত্রণা, সমাজের চোখ রাঙানি, আর কর্মক্ষেত্রের টানাপোড়েন মিলিয়ে এক জটিল সময় পার করেছেন তিনি।

একসময় নিজের দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকেও বেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে শুধুমাত্র মানসিক শান্তির খোঁজে। সংসার এবং পেশাগত জীবনের চাপে ক্রমেই ভেঙে পড়েছিলেন অনুভা। যদিও প্রথমে রবি ঘোষকে বিয়ে করতে চাননি, পরে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও সেই টানাপোড়েন তেমন থেমে থাকেনি। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা এই অভিনেত্রীকে অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে ক্লান্ত, বিমর্ষ চেহারায় পর্দায়। এই পরিবর্তন ছিল তাঁর ভেতরের বেদনার প্রতিচ্ছবি।

আরও পড়ুনঃ ছোটপর্দায় বড় সত্য! বেআইনি আর্থিক সংস্থার কেলেঙ্কারির রহস্য নিয়ে আসছে ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’! শুধু গল্প নয়, বাংলা ধারাবাহিকে এবার বাস্তবের প্রতিধ্বনি!

এরপর মাত্র ৪২ বছর বয়সে আচমকা থেমে যায় তাঁর জীবন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি চিরবিদায় নেন গড়িয়াহাট নার্সিংহোমে, ব্রেন হ্যামারেজে আক্রান্ত হয়ে। অনুভার মৃত্যু ছিল নিছক একটি অভিনেত্রীর প্রস্থান নয়, বরং এক হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার অপমৃত্যু। তাঁর জীবন যেন এক সিনেমার ট্র্যাজিক ক্লাইম্যাক্স—যেখানে নায়িকা নীরবে হারিয়ে যায়, অথচ দর্শকের মন কাঁদিয়ে যায় তাঁর অতৃপ্ততা, তাঁর অমলিন স্মৃতি। অনুভার মৃত্যু ঘিরে রহস্য আজও থেকে গেছে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে।