ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহধর্মিণী, গুণী সঙ্গীতশিল্পী নীলিমা মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন নীরবেই! স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন যেমন, ঠিক তেমনই নিজেও ছিলেন ‘সুরশ্রী’! বাংলা সংস্কৃতিকে তিনি দিয়েছেন অনন্য সব উপহার, জানলে অবাক হবেন!

বাংলা সঙ্গীতজগতের এক নিঃশব্দ অথচ দীপ্তিমান ব্যক্তিত্ব ‘নীলিমা মুখোপাধ্যায়’ (Nilima Mukhopadhyay)। তাঁর নাম মনে করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক শান্ত, মার্জিত অথচ আত্মবিশ্বাসী মুখ। শুধু প্রখ্যাত অভিনেতা ‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর (Bhanu Bandopadhyay) স্ত্রী হিসেবে নয়, তিনি নিজেই ছিলেন এক শক্তিশালী শিল্পীসত্তা। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল, আর সেই আগ্রহই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে যায় সুরের জগতে। খেয়াল, ঠুংরি, কীর্তন, দাদরা, ভজন থেকে শুরু করে আধুনিক গান— সব ধরণের সঙ্গীতেই ছিল তাঁর সাবলীল দখল। তাঁর গলায় ছিল এমন এক আকর্ষণ যা শ্রোতাকে মুহূর্তে মুগ্ধ করে ফেলত এবং তাঁর নিষ্ঠা ছিল অভাবনীয়।

রেডিওতে তাঁর যাত্রা শুরু হয় মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে, যা তখনকার সময়ে এক অসামান্য কীর্তি। গান শেখা শুরু করেছিলেন গুরু সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে, যাঁর কাছে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরাও তালিম নিয়েছিলেন। এমনকি গুরু বিয়ের পরেও শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাঁকে গান শেখাতেন, তাঁর প্রতি এমন ভরসা খুব কম ছাত্রীর ভাগ্যে জোটে। কিন্তু নিজের প্রতিভার প্রথম প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁকে ছদ্মনাম রাখতে হয়েছিল! ‘প্রীতি মুখার্জি’ নামে প্রথম জীবনে রেকর্ড করলেও, পরে ‘নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামেই নিজের পরিচিতি তৈরি করেন।

নীলিমা দেবীর সংগীত জীবনে যেমন ছিল বেতার, রেকর্ড, সিনেমা ও জলসার অবাধ বিচরণ, তেমনি তিনি নিজে ছিলেন এক অসাধারণ সুরকার ও গীতিকারও। নিজের হাতে লিখেছেন– স্বরলিপি, নাটকের গান, এমনকি যাত্রাপালার সুরও করেছেন। বিভিন্ন নাটকের জন্য গান বানিয়েছেন, বিশেষ করে মহিলা সমিতির জন্য নাটক লিখেছেন, আবার নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন ‘সঙ্গীতশ্রী’ নামের একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়, যেখানে শেখানো হতো নাচ, গান, গীটার, পিয়ানো ইত্যাদি।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্য জীবন ছিল অত্যন্ত সুখের। তাঁরা পরস্পরের শিল্পীসত্তাকে শ্রদ্ধা করতেন এবং সমর্থন করতেন নিঃশব্দে। নিজেদের প্রযোজিত ছবিতেও গান গেয়েছেন নীলিমা, যদিও কখনও কখনও তাঁর গান ছবির এডিটিং পর্যায় বাদ পড়েছে। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। জলসায় তিনি গান গেয়েছেন– ‘লতা মঙ্গেশকর’, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’, ‘গীতা দত্ত’, ‘মুকেশ’-এর মতো দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গে। এমনকি ‘ভূপেন হাজারিকা’র সুরেও গান গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

আরও পড়ুনঃ ওটা গল্প না জগাখিচুড়ি! চিরসখার গল্প দেখে লীনা গাঙ্গুলীকে ক’টাক্ষ অভিনেত্রী অনামিকা সাহার! নিজের মুখেই জানালেন কেন প্রথম থেকেই তিনি ধারাবাহিকের কাছ থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন!

তাঁর লেখা কবিতাও ছিল জনপ্রিয়। ‘হারানো বাউল ভাই’, ‘সমাজসেবিকা’, ‘আসল পাগল’ বা ‘দ্যাখো অগ্রগতি ভাই’-এই সব কবিতাগুলি উল্লেখ যোগ্য। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন, অসুস্থ থাকার পর। ছেলে গৌতম জানিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে পায়ের সমস্যায় ভোগার পর অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপর এই অবস্থার অবনতি। মৃ’ত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। শরীর ভেঙে পড়লেও তাঁর মন ভাঙেনি কখনোই। শেষদিন পর্যন্ত তিনি শিল্পের পাশে ছিলেন, শিল্পকেই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে।