যখন কলকাতা জুড়ে উৎসবের আমেজ, আলো, আনন্দ আর ঠাকুর দেখার ভিড়, তখন বাদামতলা আষাঢ় সংঘের পুজোর মণ্ডপের সামনে নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করছেন এক চিত্রকর। ভিড়ের মানুষ জানেন না, এই সাধারণ শিল্পীর হাতেই আঁকা সেই পটচিত্র একসময় স্থান পেয়েছিল জনপ্রিয় বাংলা ছবি ‘রক্তবীজ’-এ। নাম তাঁর সিরাজউদ্দৌলা চিত্রকর—একজন পটচিত্র শিল্পী, যিনি আজও নিজের প্রাপ্য টাকা আর সম্মান দুটোই পাননি। অভিযোগের আঙুল উঠেছে প্রখ্যাত পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের প্রযোজনা সংস্থা উইন্ডোজ প্রোডাকশন-এর দিকে।
সব শুরু ২০২৩ সালে, যখন ‘রক্তবীজ’ ছবির জন্য সিরাজ চিত্রকরকে যোগাযোগ করেন প্রযোজনা সংস্থার এক সদস্য, ‘রবিদা’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি। সিরাজ বলেন, “রবিদা আমার পটচিত্র দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। তারপর নিয়ে যান শিবপ্রসাদ বাবুর কাছে। উনি নিজে আমাকে একটা বিশাল চণ্ডীমঙ্গল স্টাইলে দুর্গা পটচিত্র আঁকতে বলেন। আমি জানিয়েছিলাম, কাজটা করতে প্রায় এক লাখ টাকার খরচ পড়বে। পরে ৮০ হাজারে চুক্তি হয়।” সাত দিনের মধ্যে সহকারীকে নিয়ে কালীঘাটে কাজ শেষ করেন সিরাজ। কিন্তু টাকা? “শেষে হাতে পাই মাত্র ২৮ হাজার। বাকি টাকা আর কোনওদিনও এল না,” বলেন তিনি।
এই পটচিত্রই দেখা গিয়েছিল ছবির জনপ্রিয় গান ‘গৌরী এলো’-র দৃশ্যে—যেখানে অভিনয় করেছেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনসূয়া মজুমদার। সেই দৃশ্যেই পটচিত্রের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সিরাজকেও। অভিনয় করেছেন তিনিও, কিন্তু সেখানেও নেই কোনও পারিশ্রমিক। তিনি বলেন, “বলে ছিলেন পরের সিনেমায় সুযোগ দেবেন, কিন্তু আর ডাকেননি। অন্য সবাই টাকা পেয়েছেন, শুধু আমি বঞ্চিত।”
সিরাজের কথায়, “আমাদের পূর্বপুরুষরা পটচিত্র দেখিয়ে গল্প বলতেন, বিনিময়ে পেতেন চাল-ডাল। এত বছর পরেও আমরা সেই অবস্থাতেই রয়ে গেলাম। আজ সিনেমা করে মানুষ কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে, আর আমি নিজের পরিশ্রমের টাকা পর্যন্ত পাইনি।” এমনকি তিনি তাঁর আঁকা পটচিত্রটি ফেরত চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটিও আর পাননি। “বললেন, এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,” বলেন সিরাজ হতাশ গলায়।
তবে হাল ছাড়েননি এই শিল্পী। সম্প্রতি কলকাতা বইমেলায় ‘হাতেখড়ি প্রকাশন’-এর জন্য বইতে ছবি এঁকে নতুন করে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। “ওরা অন্তত শিল্পীর সম্মান দেয়,” বলেন সিরাজ। এ বছর পুজোর পর তিনি আবার ফিরছেন গ্রামে, সঙ্গে নিয়েছেন নিজের বিক্রির জন্য কিছু ছবি। “বৃষ্টি হয়েছে, বিক্রি খুব একটা হয়নি। তবু এটা আমার নিজের উপার্জন। সিনেমার জন্য কাজ করে শুধু লোকসানই হয়েছে,” বলেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ “মায়েরা কখনও দূরে যায় না, সব সময় আমাদের কাছেই থাকে!”— বিজয়া দশমীতে কৌশাম্বী ভাসলেন আবেগে! গত বছর বিয়ের পরেই মায়ের মৃ’ত্যু, এবার দেবী দুর্গার মধ্যেই খুঁজে পেলেন হারানো মাকে! তাঁর দুঃখ ছুঁয়েছে অনুরাগীদেরও মন!
এই এক শিল্পীর কণ্ঠে ধরা পড়েছে বহু অবহেলিত শিল্পীর না বলা গল্প—যেখানে প্রতিভা আছে, পরিশ্রম আছে, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান নেই। সিরাজ চিত্রকর শুধু নিজের জন্যই নয়, বাংলার অসংখ্য শিল্পীর হয়ে আজ এই প্রশ্ন তুলেছেন—“আমাদের পরিশ্রমের মূল্য কি সত্যিই এত কম?”