“ধারাবাহিকের কাজ এখন ‘অফিসে’ কাজ করার মতো!” “সময় বেঁধে শুটিং, গল্প কোথায় যাবে কেউ জানে না!”— বাংলা টিভির বর্তমান চিত্র নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য রীতা চক্রবর্তীর! বিনোদনের ধারা পরিবর্তনে আক্ষেপ করে কি বললেন তিনি?

দেখতে দেখতে দুই দশকের পথচলায় বিনোদন দুনিয়ার বহু বাঁক পার হয়েছেন— ‘রীতা দত্ত চক্রবর্তী’ (Rita Dutta Chakraborty)। কঠোর পারিবারিক বাঁধা পেরিয়ে, নিজের নেশাকে লালন করেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ এতটাই তীব্র ছিল যে এক সময়ে রাতদিন ধরে তিনশিফটে কাজ করতে হয়েছে, সেই সময়ের মেহনতি রুটিই আজ তাঁর পরিচয়ের অংশ। রাজা সেন, রবি ওঝা থেকে তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকদের বিশ্বাস ও প্রশংসা পেয়েও সিনেমার ক্ষেত্রে সুযোগ সীমিতই রয়ে গিয়েছে, তবু ধারাবাহিকের কাজ করেই তিনি নিজের পরিচয় সুদৃঢ় রেখেছেন।

ভাষার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকায় তিনি এখন বাঙালি কথ্যভাষায় ভঙ্গ দেখে কষ্ট পান, আবার যখন কণ্ঠে সরল-ভদ্র বাংলা শোনা যায়— যেমন যাদবপুরের সাংসদ সায়নী ঘোষের বক্তব্যে, তখন গর্ববোধ করেন। শৈশব থেকেই পরিশ্রম আর শেখার খিদে নিজের অংশ করে নিয়েছেন তিনি। কলেজের থিয়েটার থেকে বাদল সরকারের ওয়ার্কশপে,হয়ে ‘যুববাণী’র সঙ্গে হঠাৎ করে সংযোগ—সবটাই মিশে গিয়েছিলো তাঁর শিল্পচর্চায়। নাচের অনুশীলন শুম্ভু ভট্টাচার্যের কাছে, আর অভিনয়ের প্রথাগত পাঠ শুরু হয় তৃপ্তি মিত্রের থেকে।

এমনকি এক যুগ তাঁর কাছেই থাকতেন রীতা, সকালের খাবার খেয়ে সারাবেলা চর্চায় যেভাবে দিন কেটেছে, সেই বন্ধন ও ভারসাম্যই পরবর্তীতে তাঁর কর্মজীবনের ভিত্তি করে তোলে। এই নিবিড় অধ্যবসায়ই তাঁকে শিল্পীর অন্যতম মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের ভাষা-চর্চা নিয়ে তাঁর কড়া মতে, ইদানীং কুটিল ও অ’শ্লীল শব্দপ্রয়োগ যেন চলাচলের স্বাভাবিকতায় পরিণত হচ্ছে। যাকে তিনি ফ্যাশন নয়, বরং ‘কুশিক্ষা’র প্রকাশ বলে দেখেন। সেটে এখন অনেকেই নৈরাজ্যে, অনেকে অগোছালোভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যান।

এতে যেসব শৈশব শিল্পী কাজ করছে, তারা কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে তা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন। রীতার কাছে অভিনয়ের পরিপূর্ণতা মানে শুধু বোলচাল নয়— স্থান, কাল ও চরিত্র অনুধাবন করাও জরুরি, এদিক থেকে আজকের কার্যপদ্ধতিকে তিনি ফের সংস্কারের অভাব আছে বলে মনে করেন। ধারাবাহিকের বাস্তবতা নিয়ে তাঁর বক্তব্য আরও স্পষ্ট– অনেকে এটাকে পেশা ও অর্থোপার্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন, ফলে ধারাবাহিককে ‘অফিস’-এর মতো দেখা শুরু হয়েছে।

চরিত্রের বিস্তৃতি আগের মতো সুনির্দিষ্ট না থাকায় অভিনয় অনেক সময় টিআরপি আর কাহিনির চাপে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, কখন কোথায় কাহিনি ঘুরবে, সেটাও অনেকে জানে না। তবু তিনি বলেন, মাধ্যমটিকে হেয় করা যায় না—ধারাবাহিকে একসঙ্গে যে কঠিন সূক্ষ্ম কাজগুলো করতে হয়, তা করতে হলে ধৈর্য, দক্ষতা ও আনুগত্য লাগে, অনেকেই যারা আজকের পরিচালকরা এক সময়ে ছিলেন একসময় চতুর্থ সহকারী, সেটাই প্রমাণ করে সময় ও পরিশ্রমের মুল্য। সবশেষে তিনি তরুণদের জন্য বলেন, এই ত্রুটি একটু মনযোগী শিক্ষায় সারানো সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ তিন দশকের দোরগোড়ায় অপরাজিতা-অতনুর দাম্পত্যে প্রতিটি দিনই উৎসব! প্রেম থেকে বিয়ে তারপর বড় সংসার, সুখী দাম্পত্যের ২৮ বছরের বিবাহবার্ষিকীতে অভিজ্ঞতা নিয়ে কি বলছেন অভিনেত্রী?

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, নিজের চোখে কাজ করেতে দেখা একজন তরুণ অভিনেতা, যার মধ্যে এসব ঘাটতি ছিল কিন্তু সেগুলো তিনি ধীরে ধরে ঠিক করে দিচ্ছেন, কারণ জানার আগ্রহই বড় পাওয়া। শিশুশিল্পীদের পড়াশোনা যেখানে ছিটকে যাচ্ছে, সেখানে শিক্ষার আয়োজন ও মানবিক চিন্তাই তাদের পেশাগত স্থিতি ও জীবনের দিগন্ত প্রসারিত করবে। দীর্ঘজীবী ধারাবাহিক অভিনেত্রী হিসেবে তিনি এখনও বাংলা ভাষা ও মঞ্চের প্রতি নিবেদিত—এমন একটি সংস্কৃতি চান যেখানে ভাষা শুদ্ধ থাকবে, শিল্পের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে এবং নতুন প্রজন্ম তাতে করে নিজের পরিচয় গড়তে পারবে।

You cannot copy content of this page