শেষ বয়সে অর্থের জন্য কাজ ভিক্ষে করতে হয় পরিচালকদের কাছে, নিদারুণ কষ্টে কেটেছিল কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন

সময় যে মানুষকে কখন কোথায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় জনপ্রিয় অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Kali Banerjee ) দুঃখজনক পরিণতি দেখলে সেটা বোঝা যায়! তাই পরশপাথর , লৌহ কপাট ছবির জনপ্রিয় অভিনেতাকে সময়ের ফেরে একদিন ঘুরতে হয়েছিল পরিচালকদের দোরগোড়ায়! নিজের জীবন যাপনের জন্য করতে হয়েছিল অনেক নিম্নমানের চরিত্র! কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই জীবনী শুনলে চোখে জল আসে চলচ্চিত্র প্রেমীদের! তখন উত্তমকুমারের ( Uttam Kumar ) যুগ শেষ হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রের বেহাল দশা। সেই সময় রঞ্জিত মল্লিককে নায়ক করে বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুললেন পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। অঞ্জন চৌধুরীর সুপার ডুপার হিট সিনেমা শত্রু বাংলা সিনেমাকে আবার তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দিল। সেই সময় জনপ্রিয় অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালকের কাছে গেলেন কাজ চাইতে! জানালেন নিজের অসহায়তার কথা! কাজের অভাবে দিন চলছে না তার!

পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর কাছে গিয়ে অভিনেতা বললেন,“ বাবা আমি আর কাজ পায় না, তুমি যদি আমাকে কাজ দাও, তাহলে না খেয়ে মরতে হয় না আমাকে।” অঞ্জন চৌধুরী কথা দিয়েছিলেন তিনি কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাজ দেবেন। নিজের কথাও রেখেছিলেন স্বনামধন্য পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী। তার গুরুদক্ষিণা, ছোট বউ ইত্যাদি ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে জনপ্রিয় চরিত্রে সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল এটা অনেকে জানলেও অনেকেই জানেন না অভিনয়ের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছিল!

১৯২১ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার কালীঘাটে জন্ম হয় অভিনেতার। ছোট থেকেই পড়াশোনার থেকে ফুটবল খেলার প্রতি বেশি উৎসাহ ছিল তার। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলতে যেতেন এবং এই খেলার জন্য পুরস্কারও পেয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলায় একবার বাগবাজারে মাসির বাড়িতে যাত্রা দেখতে গিয়ে অভিনয়ের প্রতি নিজের অদম্য আকর্ষণ অনুভব করতে পারেন। এরপর থিয়েটার থেকে গণনাট্য আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যান কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।
বামপন্থী নেতা অবনী লাহিড়ীর বোন প্রীতির সাথে, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। এরপর সংসারে চরম আর্থিক অনটন নেমে আসে তাদের। সেই সময় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবির ‘গণশা’ চরিত্রের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা। এরপর অযান্ত্রিক, নীল আকাশের নিচে, লৌহ কপাট, পরশপাথর ইত্যাদি ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। ষাটের দশকে হিন্দি ছবিতেও কাজ করেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায় যার মধ্যে ‘বাবুর্চি’ ছিল অন্যতম। কিন্তু সেখানে মন টেকে নি তার, তাই বলিউডের কাজ ছেড়ে আবার বাংলা চলচ্চিত্রে ফিরে আসেন অভিনেতা। কিন্তু তখন সময় বদলে গেছে, অভিনেতার বয়সও বেড়ে গেছে ভালো চরিত্রের অফার ও আর পাচ্ছিলেন না তিনি। তাকে ভালো চরিত্র দেওয়ার মত সেই সময় বাংলা ছবিতে পরিচালকও ছিল না। আর্থিক কারণে তাকে এমন চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে যা দেখে অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন কিন্তু শেষ দিন অবধি অভিনয় করে গিয়েছেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: এর‌ই নাম প্রেম! চন্দন সেনের মারণ রোগের কথা জেনেও তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন স্ত্রী!

সবথেকে বড় কথা হল প্রথম জীবনে অনেক বড় বড় ছবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কেই শেষ জীবনে এসে সামান্য কিছু টাকার জন্য অনেক নিম্নমানের চরিত্র করতে রাজি হতে হয় কালী ব্যানার্জীকে। তবে শিল্পী হিসেবে তার যে সম্মান পাওয়ার কথা ছিল সেই যোগ্য সম্মান তিনি কোন‌ওদিন পাননি। কোন‌ও সরকার শিল্পীর যোগ্য মান তাকে দেন নি। কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী গণনাট্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া কালী বন্দোপাধ্যায়‌কে ভুলেই গিয়েছিল কমিউনিস্ট সরকার। তার জীবনের শেষ ছবি ‘তান্ত্রিক’এ অভিনয় করবার সময় বৃষ্টিতে ভিজতে হয় তাকে, যার ফলে ব্রঙ্কো- নিউমোনিয়া হয় আর তার জেরেই ১৯৯৩ এর ৫ জুলাই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন জনপ্রিয় শিল্পী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।