২০১৩ সালের ৩০ মে, বাঙালি সকালে উঠে শোকস্তব্ধ হয়েছিল এক মর্মান্তিক সংবাদে—চলে গেছেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘুমের মধ্যেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে। চিকিৎসকদের মতে, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও তাঁর অকাল প্রয়াণ নিয়ে বিতর্ক আজও রয়ে গেছে।
ঋতুপর্ণ ছিলেন এক অনন্য শিল্পী, যিনি সমকামিতা ও লিঙ্গ পরিচয়ের গণ্ডি ভেঙে নিজের মতো করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর জীবনযাত্রা ও শারীরিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাই কি তাঁকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল? হরমোন থেরাপি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, নাকি প্রবল মানসিক চাপ—এই প্রশ্নগুলো বারবার ফিরে এসেছে তাঁর অনুরাগীদের মনে।
সম্প্রতি, এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছেন প্রবীণ অভিনেতা দীপঙ্কর দে। বাল্মিকী চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দীপঙ্করের কথা’ বইতে তিনি দাবি করেছেন, ঋতুপর্ণ স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি, বরং আত্মহত্যা করেছিলেন। দীপঙ্করের মতে, ঋতুপর্ণ ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা, যিনি সমাজের প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই লড়াই সহজ ছিল না।
ঋতুপর্ণর নারীসত্তার প্রকাশ ও যৌন পরিচয় নিয়ে সমাজের কটাক্ষ ও অসহযোগিতা তিনি বারবার অনুভব করেছেন। দীপঙ্কর বলেন, “ঋতুর প্রবল যৌন চাহিদা ছিল, যা তার মানসিক ও শারীরিক জীবনকে প্রভাবিত করত। কিন্তু টালিগঞ্জের বহু মানুষ তার সঙ্গ চেয়েছে, আবার প্রয়োজনে দূরে সরে গেছে। নির্মমতা ও প্রতারণা সে সহ্য করেছে বহুবার।”
ঋতুপর্ণ নিজেও এই বিচ্ছিন্নতা ও একাকিত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এক সাক্ষাৎকারে কৌস্তব বক্সীকে তিনি বলেছিলেন, “আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে লোকে ফিসফাস করতে ভালোবাসে। আমি যদি কোনও পুরুষ অভিনেতার সঙ্গে একাধিকবার কাজ করি, তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে আমরা সম্পর্কে আছি। এসব আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে।” তিনি আরও বলেছিলেন, “এই দেশে সমকামী সম্পর্ক এখনো ট্যাবু। এমন একজন মানুষ পাওয়া কঠিন, যে আমার তারকাখ্যাতির বাইরে গিয়ে শুধু মানুষ ঋতুপর্ণকে ভালোবাসবে।”
বাংলা সিনেমায় এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ। ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’, ‘রেনকোট’, ‘চোখের বালি’—এইসব সিনেমায় তিনি নারীজীবন, সম্পর্কের জটিলতা ও সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর ছবিতে সংবেদনশীলতা যেমন ছিল, তেমনই ছিল বিদ্রোহের সুর। কিন্তু ব্যক্তি ঋতুপর্ণের লড়াই ছিল আরও কঠিন। একদিকে শিল্পীসত্তার উৎকর্ষ, অন্যদিকে সমাজের অবহেলা ও একাকিত্ব—এই দ্বন্দ্ব হয়তো তাঁকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল।
আরও পড়ুনঃ টলিপাড়ায় গন্ডগোলের কারণে শুটিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ‘কোন গোপনে মন ভেসেছে’! চোখের জল আটকাতে পারলেন না শ্বেতা
তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি পরিকল্পিত আত্মহনন, তা হয়তো চিরকাল বিতর্কের বিষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু তাঁর জীবন, সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের প্রতি প্রশ্ন তোলার সাহস তাঁকে বাংলার চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।