বাংলা টেলিভিশনে বিভিন্ন সময়, ধারাবাহিকে পুরোহিত চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। কখনও নায়ক-নায়িকার বিয়ে দিতে, তো কখনও মন্দিরের প্রধান। কিছুদিন আগেই তাঁকে দেখা গেছে জি বাংলার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কুসুম’-এ। কিন্তু জানেন কি তাঁর পরিচয়? তিনি বর্ষীয়ান অভিনেতা ‘ইন্দুভূষণ রায়’ (Indubhushan Roy), যিনি ৮১ বছর বয়সেও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে যেন নবীন প্রাণ ফিরে পান। বর্ধমানের এক ছোট গ্রামে, ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে ১৯৪৬ সালে জন্ম তাঁর। সেই সময়ের গ্রামীণ পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন— সবার পেশা প্রায় এক, কৃষিকাজ ও পৌরহিত্য।
দুর্গাপুজো এলেই পুরো গ্রাম মেতে উঠত আনন্দে, প্রতিদিন পালা করে রান্না করত প্রতিটি পরিবার। সেই সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন ইন্দু বাবু। তাঁর পরিবারেও ছিল শিল্পচর্চার গভীর ঐতিহ্য। ছোট থেকেই দেখেছেন, তাঁর বাবা, কাকা ও দাদারা দারুণ গান গাইতেন। সেই থেকেই তাঁর মনে জন্মায় সঙ্গীতের প্রতি গভীর টান। গানের তাগিদেই তিনি খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই বইখাতা সরিয়ে রেখে মন দিয়েছিলেন সুরের সাধনায়। আজও তিনি বলেন, “রোজ একটা গান না গাইলে রাতে ঘুম আসে না।” মঞ্চে গান গাওয়াই তাঁর প্রিয় নেশা ছিল।
একসময় দুর্গাপুরে চাকরি করতেন, আর সেখানেই ঘটেছিল জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে অনুষ্ঠান করতে এসেছিলেন সেখানে। ইন্দু বাবু বিনীতভাবে প্রণাম করতে গেলে মান্না দে প্রথমে অবাক হয়ে বলেন, তিনি কারও প্রণাম নেন না, বরং পাশে বসতে বলেন তাঁকে। বেশি রাখঢাক না করে তিনি বলেই ফেলেন যে, মান্না দের সঙ্গে গান গাইতে চান। রবিন চ্যাটার্জিকে তানপুরা চেয়ে পাঠান মান্না দে, তারপর দেড় ঘণ্টা ধরে চলেছিল সেই গানের আড্ডা। মান্না দে শেষে বলেছিলেন, ” এতো ভালো গলা তোমার!
তুমি যদি বোম্বেতে থাকতে, আমি তোমাকে গান গাওয়াতে সুযোগ দিতাম।” সঙ্গীতের প্রতি তাঁর এই ভালবাসার কথা জানতেন অজয় চক্রবর্তীও। তিনি যখনই দুর্গাপুরে যেতেন অনুষ্ঠান করতে, মঞ্চে ওঠার আগে ইন্দু বাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন। এমনকি একসময় তাঁকে চাকরি ছেড়ে গানের দলে যোগ দিতে পর্যন্ত অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ইন্দু বাবু ছিলেন বড়ই সহজ মানুষ। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেমন ছিল না, স্থিতিশীল জীবনই তাঁর বেশি প্রিয় ছিল। দিনভর চাকরি শেষে অফিস কোয়ার্টারে গানের ক্লাস নিতেন।
যেখানে অতিথি হিসেবে আসতেন কিংবদন্তি শিল্পী কমল বোস ও শ্যামল বোস। বিভিন্ন সময়ে নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি ও আধুনিক গানের জন্য আকাশবাণীতে পাঁচবার অডিশন দিয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্য অন্য পথ লিখেছিল তাঁর জন্য। অভিনয়ে আসার গল্পটিও বেশ অবাক করা। ২০১০ সালে যখন টেলিভিশনে ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ ধারাবাহিকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বামাক্ষ্যাপা চরিত্রে অভিনয় করছিলেন অরিন্দম গাঙ্গুলী এবং পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সুব্রত রায়। ইন্দু বাবুর মনে হলো এটাই সুযোগ।
তিনি গিয়ে অভিনয় করার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। দেখতে বরাবরই খুব সুপুরুষ ছিলেন ইন্দুবাবু, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চেহারার জোরেই খুব সহজেই সুযোগ পেয়ে যান। প্রথম ধারাবাহিকেই পুরোহিতের চরিত্রে অভিনয় করে এতটা প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন যে, আজও যত ধারাবাহিকেই তাঁকে দেখা যায়, প্রায় সবেতেই তিনি পুরোহিত বা পূজারীর ভূমিকায়। বর্তমানে তিনি একাই থাকেন কলকাতায়। বিয়ে করেননি, কারণ ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল সন্ন্যাস জীবন যাপন করবেন, উত্তর কাশীতে গিয়ে স্থায়ী হবেন।
আরও পড়ুনঃ “কুনাল আমার কাছের মানুষ, কে বিজেপি করে আর কে তৃণমূল করে—অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমার কিছু যায় আসে না!” কুনাল ঘোষের বিতর্কিত মন্তব্যের পর অবশেষে মুখ খুললেন দেব!
জীবনের অনেকটা সময় চাকরির সূত্রে সারা ভারত ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে কখনও অনুশোচনা ছিল না। এই বয়সেও ফাঁকা বসে থাকতে পছন্দ করেন না, বয়সের ভারে শরীর ক্লান্ত হলেও, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে সব ক্লান্তি ভুলে যান তিনি। ইউটিউবে নিজের একটি চ্যানেল পর্যন্ত রয়েছে যেখানে নিয়মিত গান প্রকাশ করেন তিনি। অভিনয় ও সঙ্গীত— এই দুই-ই তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আর আজও পর্দায় তাঁর উপস্থিতি দর্শকদের মনে আলাদা আনন্দ জাগায়।