‘ব্রিটিশ আমল থেকে আমার যৌবনকাল পেরিয়ে মা খোলাখুলি তাঁর পুরুষ বন্ধুদের ডেট করতেন’, মায়ের স্মৃতিচারণে কবীর সুমন
করোনার অতিমারিতে ফের দেশে নেমে এসেছে হতাশা। এরই মধ্যে এক শীতের দিনে মায়ের স্মৃতিচারণে মাতলেন বর্ষীয়ান সঙ্গীত শিল্পী কবীর সুমন। যার গানে এখনও বাঙালি মুগ্ধ, যার কলমে যেন আজও বিপ্লব ঝড়ে পড়ে। সেই তিনিই মাকে নিয়ে স্মৃতির সাগরে ডুব দিলেন।
আশির দশকে মায়ের সঙ্গে ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন কবীর সুমন। কোনও এক পরিচিত সেই ছবি তাঁকে হঠাৎই পাঠিয়েছেন। আর তা দেখেই বেশ আবেগঘন হয়ে পড়েছেন কবীর সুমন। ফের ফিরে গিয়েছেন অতীতে। নিজের অনুরাগীদের সঙ্গে তাঁর মায়ের ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
কবীর সুমন সকলের সঙ্গে নিজের অনুভূতি শেয়ার করে লেখেন, “মায়ের সঙ্গে আমার ছবি খুব কম। এই ছবিটা কে যেন পাঠিয়েছেন আমায়। সেই কবে আমেরিকায় তোলা। ১৯৮০ সালে ভি ও এর চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মূর্খ তাই চাকরি ছেড়ে ফিরে এসেছিলাম”।
মা-কে লিখতে গিয়ে তিনি লেখেন, “অসামান্য এক মহিলা ছিলেন আমার মা। সারাজীবন স্বাধীনচেতা। বেপরোয়া। কারুর তোয়াক্কা করেননি। জন্মস্বাধীন। অক্লান্ত পাঠক। বই আর বই। আমার ৭/৮ বছর বয়স থেকে ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে চাকরি করতেন। আমাকেও নিত্যজীবনে স্বাবলম্বনের পাঠ দিয়েছিলেন। মা মা” করিনি কখনও। মার্ক্সিস্ট ছিলেন। সিপিআইএমের সমর্থক। তারপর নকশালপন্থী”। ওদিকে জ্যোতি বসুর কাণ্ডজ্ঞানভিত্তিক সোজাসাপ্টা কথাবার্তার ভক্ত’।
গানওয়ালার কথায় তাঁর মায়ের গানের প্রতি বরাবর ঝোঁক ছিল। তিনি লেখেন, “সুগায়িকা ছিলেন। চারের দশকে বেতারে তো গাইতেনই, গ্রামোফোন রেকর্ডও ছিল। বাবা আকাশবাণীতে কাজি নজরুল ইসলামের সুপারিশে চাকরি নেওয়ার পর বাবা মা দুজনেই বেতারে গান গাওয়া বন্ধ করে দেন নীতিগত কারণে। মা অভিনয়ও করতেন। রক্তকরবীর এক বিখ্যাত শো’তে মা ছিলেন নন্দিনী আর দেবব্রত বিশ্বাস বিশু পাগল। নিউ এম্পায়ারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। আমার ধারণা, দুজনের মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রণয়ও ছিল। প্রথমবার চীনে গান গাইতে গিয়ে (মনে হয় যেন গত জন্মের কথা) দেবব্রতবাবু মার জন্য এক রাশ উপহার নিয়ে এসেছিলেন। কাঁচের তৈরি কী চমৎকার সব ক্ষুদে পুতুল। দেবব্রত বিশ্বাস এলআইসি’র এজেন্ট ছিলেন। তাঁর প্রথম দুই পলিসি নিয়েছিলেন মা আর বাবা”।
তাঁর মা ছিলেন বরাবরের স্বাধীনচেতা। সেই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কবীর সুমন লেখেন, “মা স্বাভাবিকভাবে, খোলাখুলি তাঁর পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে ডেট করতেন সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমার যৌবনকাল পেরিয়ে। আমার বাবার তাতে কোনও অসুবিধে দেখিনি। ছেলেবেলা থেকে যৌবনকাল অবধি মা বাবাকে দস্তুরমতো চুমু খেতে দেখেছি – লুকিয়ে নয়। আমার সামনেই তাঁরা আদর করতেন”।
তিনি নিজের নাম বদলানোর পর অনেকেই তাঁর মাকে নানান কথা বলতেন। কবীর সুমনের কথায়, “আমি আমার নাম পাল্টানোর পর অনেকে আমার মাকে ফোন করে বলতেন, ‘আপনার ছেলে তো মুসলমান হয়ে গেল!’ আমার মা তাঁদের বলতেন, ‘আমার ছেলে বলেই তো হলো, নয়তো কি তোমার বাবা হবেন?’ – ব্রিটিশ আমলে মার সঙ্গে এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমান যুবকের আলাপ ও মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল। বিয়ের কথাও হয়েছিল। সে আমলে সিভিল ম্যারেজ ছিল না। আমার মা আমায় বলেছিলেন সেই যুবকটির জন্য মার মুসলমান হতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু মাঝপথে সুগায়ক ও সুদর্শন সুধীন্দ্রনাথ ব্যুহে ঢুকে পড়ায় সেই ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের কপাল পুড়ল”।
শীতের দুপুরে রোদ পোহাতে পোহাতে মা-কে নিয়ে স্মৃতি উগড়ে দিলেন কবীর সুমন। মায়ের উপস্থিতি তিনি সবসময় অনুভব করেন। তাঁর সমস্ত কাজে, সমস্ত সুরে মিশে রয়েছেন তাঁর মা।
শেষে কবীর সুমন লেখেন, “মা মাঝেমাঝে আসেন। দেখতে পাই না। কিন্তু বুঝতে পারি তিনি এসেছেন। গান শুনতে চান। পাশের বাড়ির তিন তলায় একটি ছেলে বাঁশি শিখছেন। তাঁর রেয়াজের সূত্রে এ পাড়ায় বাঁশির সুর ঘুরে বেড়ায়। জয় সুর”।