“ছবিটার পারিশ্রমিক মুখে আনা যায় না, অর্থের চেয়ে বড় ছিল এই চরিত্রটা!”— টাকার জন্য নয়, চরিত্রকে ভালোবেসেই বিরাট ত্যাগ করেছিলেন শাশ্বত! ‘নীলকণ্ঠ’ হয়ে উঠল তাঁর জীবনের সেরা অধ্যায়!

বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের কাছে ২০১৩ সালের “মেঘে ঢাকা তারা” (Meghe Dhaka Tara 2013) এক বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে, যা শুধুমাত্র নামেই নয়, আত্মায়ও ঋত্বিক ঘটকের (Ritwik Ghatak) প্রতি এক নিবেদিত শ্রদ্ধার্ঘ্য। পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি এই ছবির মাধ্যমে একজন বিপ্লবী চলচ্চিত্রকারের জীবন যন্ত্রণা এবং শিল্পীসত্ত্বার নির্যাস তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত এই ছবি মূলত কালো-সাদা রঙে ধারণ করা হলেও, শেষ দৃশ্যটি রঙিন!

ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘নীলকণ্ঠ বাগচী’, যিনি বাস্তবে ঋত্বিক ঘটকের জীবন ও মনস্তত্ত্ব দ্বারা অনুপ্রাণিত, সেই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ‘শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়’ (Saswata Chatterjee)। তাঁর বিপরীতে দুর্গার চরিত্রে ছিলেন অনন্যা চ্যাটার্জি। শুধু একজন পরিচালকের জীবনই নয়, এই ছবির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে বাংলার তেভাগা আন্দোলন ও নকশালবাড়ির প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের চিত্র।

এই ছবির জন্য শাশ্বত তার চরিত্রটি আত্মস্থ করতে বহু গবেষণা করেছিলেন, ওজন কমিয়েছিলেন, এবং ঘটকের চলাফেরা, বাচনভঙ্গি ও শরীরী ভাষা আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন। শুটিং চলাকালীন এই চরিত্রে এতটাই ঢুকে পড়েন তিনি, যে বাস্তব জীবনে স্ত্রীর সাথেও কথাবার্তায় মনোসংযোগ রাখতে পারছিলেন না। এক সাক্ষাৎকারে শাশ্বত বলেন, “সেই সময়ে ‘কাহানি’ মুক্তি পেয়েছে। বব বিশ্বাসের চরিত্রে অভিনয়ের পর, একই অনেক অফার আসতে থাকে।

কিন্তু আমি জানতাম— আমি নিজেকে রিপিট করতে চাই না। যখন ‘মেঘে ঢাকা তারা’র অফার এল, তখন বুঝেছিলাম এটা একটা ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা হতে চলেছে। সেই সময়ে মহুয়ার (স্ত্রী) সঙ্গেও কথা বলতে কষ্ট হতো, মনে হতো আমি আর আমি নেই— আমি নীলকণ্ঠ হয়ে উঠেছি।” সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, সেই সময় টিভিতে তার জনপ্রিয় একটি মেগা সিরিয়াল চলছিল। একই প্রোডাকশনের হওয়া সত্বেও তিনি সেই ধারাবাহিকটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি বলেন, “সেই সময় এই ছবির পারিশ্রমিক এতটাই কম ছিল, আজ মুখে আনাও যায় না। ধারাবাহিকের পারিশ্রমিকের একভাগেরও কম! তবু আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ আমি চাইনি দুই নৌকায় পা রেখে কোনোটাকেই ঠিকঠাক দিতে। নীলকণ্ঠ চরিত্রটা আমার কাছে একটা দায়িত্ব ছিল, আমি সেটাকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলাম। এমনিতেই অভিনয় জগত অনিশ্চয়তায় ভরা, তার মধ্যে একাধিক কাজে জড়িয়ে পড়লে কোনটাতেই সফলতা পাওয়া যাবে না।”

আরও পড়ুনঃ সাক্ষ্য না ষড়যন্ত্র! চন্দ্রের মায়ের মুখে সাজানো গল্প, নতুনের নামেও ছড়াল কুৎসা! একের পর এক সাক্ষ্য ফাঁস করল চন্দ্র-কমলিনীর অতীত! রায় এখনও অধরা, কিন্তু সত্য প্রকাশ্যে! আর কেউ বাঁচাতে পারবে না চন্দ্রকে!

একটি চরিত্রকে স্মরণীয় করার তাগিদে তিনি অর্থনৈতিক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, এই মনোভাব আজকের প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য এক শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে! যখন শিল্পকে ভালোবেসে নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, তখন অর্থের মোহ হার মানে এক শিল্পীর আত্মপ্রকাশের কাছে। কমলেশ্বর মুখার্জির এই সাহসী প্রয়াস, এবং ঘটনাবহুল প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ‘মেঘে ঢাকা তারা’ শুধুই একটি সিনেমা নয় — বরং এক দর্শন, যা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে আলোচ্য হয়ে থাকবে।