দেশপ্রেমকে কেবল সংজ্ঞায় বেঁধে রাখা যায় না, তবে প্রত্যেকের ভেতরে তার প্রকাশ আলাদা রকমেই ধরা দেয়। শিল্পী ‘মেখলা দাশগুপ্ত’ (Mekhla Dasgupta) সম্প্রতি সেই ভাবনাটাকেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর নতুন মিউজ়িক ভিডিওয় (Music Video)। স্বাধীনতা দিবসের ঠিক পরেই তিনি এই ভিডিওতে গাইলেন– কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গান ‘কালের শঙ্খে বাজিছে আজও তোমারই মহিমা, ভারতবর্ষ।’ গানটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৃশ্যপট, যা দর্শকদের সামনে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা হাজির করছে।
মেখলার কথায়, এই ভাবনার জন্য যে বাজেট প্রয়োজন, তা হাতে না থাকায় প্রযুক্তির দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, শৈশব থেকেই গানটির সঙ্গে তাঁর এক বিশেষ সম্পর্ক। ছোটবেলায় শেখা এই সুরে যেমন দেশপ্রেমের আবেগ আছে, তেমনই দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার পথও খুঁজে পাওয়া যায়। তাই আলাদা করে দেশভক্তির স্লোগান তোলার বদলে এই গানই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রকাশের ভাষা। মেখলা মনে করেন, যাঁরা যুগে যুগে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোই আসল দেশপ্রেম।
এই ভিডিওর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তাঁদের জীবন্ত করে দেখানো হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মের কাছে ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে বলে তাঁর বিশ্বাস। দেশপ্রেমের প্রসঙ্গ টেনে মেখলা বলেন, একসময় দেশকে নিজের মায়ের সমান শ্রদ্ধায় দেখা হত। যেমনভাবে সন্তান মায়ের প্রতি ভক্তি রাখে, ঠিক সেভাবেই দেশের প্রতি ভক্তি ছিল মানুষের মনে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মানসিকতা ফিকে হয়েছে। আজ মুখে দেশমাতৃকার নাম উচ্চারণ হলেও কাজে তার প্রতিফলন ততটা দেখা যায় না।
দুর্নীতি, অব্যবস্থা বা নাগরিক দায়বদ্ধতার অভাব—সবই আসলে সত্যিকারের দেশপ্রেম না থাকার ফল। তাঁর মতে, যদি সত্যিই দেশকে মায়ের চোখে দেখা যেত, তবে সমস্যার পাহাড় এতটা বড়ো হয়ে উঠত না। মেখলার কথায়, “সত্যিই মা মনে করলে, দেশের রাস্তাঘাট খারাপ থাকত না! ক্ষমতা পেয়েই যে কেন মানুষ এত দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যান, আজও বুঝি না।” উল্লেখ্য, ভিডিওটিতে নারী নিরাপত্তার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। নজরুল ইসলামের গানে যে পংক্তি—“জগৎ-সভা মাঝে তাহারি সন্তান আজি মলিন মুখ লাজে বিমর্ষ”—আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন মেখলা।
স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরও দেশের মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, যা গানের পংক্তির মতোই কষ্ট দেয়। তাঁর অভিজ্ঞতাও রয়েছে এর সঙ্গে জড়িয়ে। তিনি জানান, এক স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকেরা দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার অনুরোধই করেননি, এমনকি শেষে যখন তিনি ‘বন্দে মাতরম’ গাইলেন, তখন অনেকেই আসন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এই ঘটনাকে তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমের ঘাটতির স্পষ্ট উদাহরণ বলে মনে করেন। তবে দেশপ্রেমের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুনঃ “বাবা টাকা দেননি, তাই পুরস্কার মেলেনি!” “দূর গগন কি ছাও মে-র জন্য পুরস্কারে ‘কিশোর কুমার’ নামই লেখা ছিল!”— জাতীয় পুরস্কার নিয়ে বি’স্ফো’রক অভিযোগ অমিত কুমারের! পুরস্কার বঞ্চনার পিছনে দুর্নী’তির অভিযোগ তুললেন তিনি!
মেখলার কথায়, মানুষকে কখনও ধর্ম দিয়ে বিচার করা উচিত নয়, মানুষ কেবল দু’প্রকার—সভ্য আর অসভ্য। নজরুল ইসলাম থেকে এপিজে আব্দুল কালাম, রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ—তাঁদের চিন্তাভাবনা তাঁকে প্রেরণা দেয়। তিনি নিজেকে হিন্দু হিসেবে গর্বিত মনে করলেও অন্ধ গোঁড়ামি বা ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি তাঁর কাছে অগ্রহণযোগ্য। যুক্তি, মানবতা আর মুক্তচিন্তাই তাঁর কাছে আসল দেশপ্রেমের পরিচয়। তাই তাঁর এই ভিডিও শুধু একটি গানের জন্য নয়, বরং বর্তমান সমাজে দেশপ্রেমের মানসিকতা নিয়ে এক গভীর প্রশ্নচিহ্নও ছুঁড়ে দিয়েছে।