অভিজ্ঞ অভিনেতা ‘চন্দন সেন’ (Chandan Sen) তাঁকে বরং মানুষের অভিনেতা বলা ভালো। অভিনেতা শব্দটা যতটা ভারী, সেই ভার থেকে তিনি চিরকাল মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন, বাস্তবের কাছাকাছি চরিত্রে অভিনয় যেন তাঁকে সকলের থেকে আলাদা করে তুলেছে। তাঁকে নিয়ে যতই রাজনৈতিক বিতর্ক থাক, সাম্প্রতিক পদক্ষেপে তিনি আবারও প্রমাণ করেলেন যে ‘শিল্পীর পরিচয় কোনও দলের রঙে বাঁধা নয়!’ ব্যক্তিগত মতাদর্শ এবং স্পষ্টবাদী স্বভাবের জন্য বহুবার সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
এমনকি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য সরকারি প্রেক্ষাগৃহও পাননি। মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করায় তাঁকে বহুবার কটুকথা শুনতে হয়েছে। তবু এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ নন চন্দন। তাঁর কাছে শিল্পীর দায়িত্বই সবচেয়ে বড়। সম্প্রতি সেই মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকেই টেলি সম্মান গ্রহণ করা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছিল, ‘চটিচা’টা’ বলে কটাক্ষ পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হতেই তিনি যা করলেন, তাতে নিন্দুকরাও স্তব্ধ! এক লক্ষ টাকার পুরস্কার রাখার বদলে তিনি পুরো অর্থটাই দান করে দিলেন চারটি আলাদা সংস্থাকে।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠান, ক্যা’ন্সার আক্রান্ত শিশুদের সহায়তা দেওয়া একটি এনজিও, একটি সামাজিক সেবা সংস্থা এবং আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে তৈরি ‘অভয়া মঞ্চ’। প্রতি সংগঠনেই তিনি ২৫ হাজার টাকা করে পৌঁছে দিয়েছেন কোনও প্রচার না করে, কোনও বক্তব্য না রেখেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, নিজেও ক্যা’ন্সারের সঙ্গে লড়াই করছেন চন্দন সেন। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হয় অনেক অর্থের। তাছাড়াও তাঁর নাট্যসংগঠনও আর্থিক সংকটের মুখে। তবু নিজের প্রয়োজনের আগে তিনি রাখলেন অন্যের প্রয়োজনকে।
আগেও সরকারি পুরস্কারের টাকা চা-বাগানের শ্রমিকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেদিক থেকে এই সিদ্ধান্ত কোনও ব্যতিক্রম নয়, বরং মানবিকতারই ধারাবাহিকতা বলেই মনে করেন তিনি। ভাবলে অবাক লাগে, এতকিছু জনস্বার্থে করেও তিনি বরাবর প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। অন্য শিল্পীরা যেখানে সমাজ মাধ্যম থেকে সংবাদ মাধ্যম, সর্বত্র নিজেদের উদ্যোগের প্রচার করে বেড়ান। সেখানে চন্দন সেন একেবারেই একান্তে রাখেন। শুধুমাত্র গুটি কয়েক কাছের মানুষ ছাড়া কাউকেই জানান না এইসব।
সম্প্রতি তাঁকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হতেই, তিনি বলেন যে, “আমি এইসব নিয়ে কোনও রকমের প্রচার চাই না! তাই সাক্ষাৎকার দিতেও রাজি নই। এইসব নিয়ে প্রচার করে কী হবে? আমি একা বা প্রথম নই। তালিকাটা লম্বা, যাঁরা অধিকাংশ সময়ই এইসব কাজের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। যে অর্থ দিয়েছি, সেটা তো আমার না! জনগণের শুল্ক থেকে আসা অর্থ, রাজ্য আমায় দিয়েছে সন্মান জানিয়ে আর আমি সেটা সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছি। এখন ঠাকুরের ইচ্ছায় আমার অনেক আছে, এই অর্থ উদ্বৃত্ত।
আরও পড়ুনঃ নায়িকা হিসেবে ‘উমা’তে বাজিমাত! বর্তমানে ‘চিরসখা’, ‘ভোলে বাবা পার করেগা’তে পার্শ্বচরিত্রে অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও কেন নায়িকার আসন অধরা শিঞ্জিনীর? প্রতিভায় তুখোড় তিনি, তবু কেন তাঁকে প্রধান চরিত্রে ভাবছে না কেউ? প্রশ্ন তুলছে নেটপাড়া
এখন প্রতিনিয়ত কাজ করছি আর তার থেকে যে অর্থ পাচ্ছি সেটায় আমার হয়ে যাচ্ছে। একটা সময় হাতে কোনও কাজই ছিল না, তখন হয়তো ভাবতাম কিন্তু এখন না!” অভিনেতা চন্দন সেন যেন নিজের জীবন দিয়ে বারবার মনে করিয়ে দেন, শিল্পীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর সমাজবোধ আর তা তিনি মঞ্চের আলোয় নয়, নীরব কাজে ফুটিয়ে তোলেন। কারণ শিল্পীর আলো যদি সমাজকেই না ছোঁয়, তবে সেই আলো নিছক আলোকসজ্জা ছাড়া আর কিছুই নয়। সবাই যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে সমাজ আরও একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর এটাই যেন চন্দন সেন নিঃশব্দে শিখিয়ে গেলেন।






