আজও টেলিভিশনের মহালয়াতে সমান প্রাসঙ্গিক দূরদর্শনের দুর্গা সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যা! কেমন ছিল বাঙালির চিরচেনা দুর্গার জীবনের শুরুটা? কী করে মিলেছিল মা দুর্গা হওয়ার সুযোগ? এখন কেনই বা অভিনয় থেকে দূরে?

বাঙালির মহালয়া (Mahalaya) মানেই ভোরের আলোর সঙ্গে মিশে যাওয়া বীরেন্দ্র কৃষ্ণের মহিষাসুরমর্দিনী, আর টেলিভিশনের পর্দায় দেবী দুর্গার মহিমা। নানা মুখ, নানা রূপে বহুবার দেবীকে দেখা গিয়েছে, কিন্তু দর্শকের মনে আজও স্থায়ী হয়ে রয়েছেন ‘সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়’ (Sanjukta Banerjee)। দূরদর্শনের পর্দায় তাঁর অভিনীত দুর্গা চরিত্র বহু প্রজন্মের মনে গেঁথে গেছে। এখন তিনি কানাডায় থাকেন, তবে এখনও মহালয়া এলেই তাঁর নাম ও মুখ যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফিরে আসে স্মৃতিতে। কিন্তু কী করে হলেন তিনি বাংলা টেলিভিশনের প্রথম এবং সর্বকালের সেরা মা দুর্গা?

শৈশব থেকেই নাচের প্রতি তাঁর আলাদা টান ছিল। যদিও সংযুক্তার পরিবার পুরোপুরি সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিল। জেঠামশাই অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন পরিচিত মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেতা, আবার জহর গাঙ্গুলির মতো কিংবদন্তি অভিনেতাও ছিলেন ঘরের মানুষ। সেই আবহের মধ্যে বড় হলেও সংযুক্তা প্রথম ব্যক্তি, যিনি চলচ্চিত্রের বদলে নাচকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। আড়াই বছর বয়সেই শুরু হয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে তাঁর জীবন। কত্থক থেকে ভরতনাট্যম— একটার পর একটা ধাপে তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী হিসেবে।

নিজের প্রতিভার জোরেই তিনি ছোটবেলাতেই দূরদর্শনের হয়ে অনেক অনুষ্ঠানে নাচ করেছেন, সেই থেকেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর ভয় কেটে যায় তাঁর। বেশ কিছুবছর পরে, কলেজে পড়াকালীন জীবনে আসে সেই সুবর্ণ সুযোগ। গুরু গোবিন্দন কুট্টির পরামর্শে তিনি একদিন শাড়ি পরে পৌঁছে যান ‘কলামণ্ডলম’ নৃত প্রতিষ্ঠানে, আর সেখানেই তাঁকে দূরদর্শনের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়। শুরু হয় দুর্গা চরিত্রে তাঁর যাত্রা। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার দূরদর্শনের মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানে তাঁকে দেবী দুর্গার রূপে দেখা যায়।

তখন তিনি ছিলেন খুবই তরুণী, তবুও পঙ্কজ সাহার মতো ব্যক্তিত্ব তাঁকে সাহস জুগিয়েছিল সেদিন এটা বলে যে, “মনে রেখো, সারা বাংলা তোমাকে দেবী হিসেবেই দেখবে।” এই কথাই তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। দর্শকের কাছে তাঁর দেবী রূপ এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে যে একের পর এক অনুষ্ঠানে তাঁকেই দুর্গা হিসেবে দেখা যায়। তবে এই যাত্রা সহজ ছিল না। শুরুতে কুমোরটুলি থেকে আনা মাটির আটটা হাত পরেই অভিনয় করতে হতো তাঁকে। ভারী গয়না, মুকুট— এসব সামলাতে গিয়ে অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন।

মাঠির হাত পিঠে নিয়ে ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি থাকতে হয়েছে সংযুক্তাকে, নাচতে হতো এবং যুদ্ধের মতো দৃশ্যেও দেবী দুর্গাকে ফুটিয়ে তুলতে হতো। পরে ফাইবারের হাত ব্যবহার করা শুরু হলেও, শুরুর কষ্টকর অভিজ্ঞতা আজও মনে আছে সংযুক্তার। অনেক সময়ই যুদ্ধদৃশ্য করতে গিয়ে ভারে নড়াচড়া করা দায় হয়ে যেত ওই কৃত্রিম হাতের ওজনে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, তাঁর নাচ আর অভিব্যক্তি মিলিয়েই দুর্গার চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। আজও টেলিভিশনের দর্শকের মনে মহালয়ার দেবী মানেই সংযুক্তার মুখ।

আরও পড়ুনঃ “থালা নিয়ে লাইনে দাঁড়াও খেতে হলে…সে অপমানটা না করলে আজ এখানে পৌঁছতাম না!” “অঞ্জন চৌধুরীর ‘হীরক জয়ন্তী’র শুটিংয়ে কেঁদে বাড়ি ফিরেছিলাম!”— বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে দারুন সাফল্য, অভিনয়ের শুরুর দিনের কষ্টের কাহিনি ভাগ করলেন অরুণাভ দত্ত!

যদিও তিনি এখন দেশের বাইরে থাকেন, তবুও বাঙালির সাংস্কৃতিতে এবং একটা প্রজন্মের কাছে দেবী দুর্গা রূপে তাঁর উপস্থিতি অবিস্মরণীয়। তিনি নিজেই বলেন এই কথা যে, ক্যামেরার সামনে দেবী হিসেবে প্রথম দাঁড়ানোর সময় ভয়ের বদলে দায়িত্ববোধটাই বেশি কাজ করেছিল। হয়তো সেই দায়বদ্ধতাই তাঁকে আজও আলাদা করে রেখেছে। পরপর এতবার দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করার পরও সংযুক্তার কাছে এটা নিছক কাজ নয়, বরং এক বিশ্বাস, যা বাঙালি ঘরে ঘরে দেবীর আবাহনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে স্থায়ীভাবে।