‘ছোট বউ’র ‘দজ্জাল শাশুড়ি’র আড়ালেই হারিয়ে গেল এক প্রতিভাবান নারীর ইতিহাস! অভিনয়ে ছিলেন শক্তিশালী, নৃত্যে ছিলেন অসামান্য! অথচ বাংলা তাঁকে ভুলে গেল! কে ছিলেন আসলে মীনাক্ষী গোস্বামী?

গত ২১ মে ছিল তাঁর জন্মদিন। ছোটপর্দা হোক বা বড়, ‘দজ্জাল শাশুড়ি’ বলতে এখনও যাঁর মুখটা চোখে ভেসে ওঠে, তিনি ‘মীনাক্ষী গোস্বামী’ (Meenakshi Goswami)‘ছোট বউ’ (Chhoto Bou) ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ— “হা কপাল! এত বড় ধাড়ি মেয়ে হয়েও মোচা কাটতে পারে না?”, “‘যার স্বামী যেমন রোজগার করবে…এরপরও যদি ছেলে হরলিক্স খেতে চায়, ২০ পয়সা দিয়ে ছেলেকে হরলিক্স বিস্কুট এনে দিও কেমন!”—আজও জনপ্রিয়। অথচ এই চরিত্রের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এক বিদুষী, আধুনিক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি নারী।

আজকের প্রজন্মের কাছে হয়তো তিনি শুধুই এক রাগী শাশুড়ি চরিত্র, কিন্তু প্রকৃত মীনাক্ষীর প্রতিভার তুলনা বর্তমানের নামজাদা অভিনেত্রীদের সাথেও হয় না। আশির দশকে বাংলা চলচ্চিত্রে এমন স্টাইলিশ, উচ্চশিক্ষিতা ও অনন্য প্রতিভার অধিকারী অভিনেত্রী খুব কমই ছিলেন। মীনাক্ষী গোস্বামী ছিলেন সেই বিরল ব্যতিক্রম, যিনি ‘ওয়াটার ব্যালে’র মতো এক অভিনব নৃত্যশৈলী বাংলার মঞ্চে উপহার দেন। জলের মধ্যে সাঁতার কেটেও যে নৃত্য উপস্থাপনা করা যায়, এই ভাবনা বাংলা সংস্কৃতির পরিসরে তিনিই প্রথম আনেন।

দূরদর্শনে তাঁর পরিচালনায় ‘ওয়াটার ব্যালে’ রীতিমতো জনপ্রিয়তা পায় নব্বইয়ের দশকে, অ্যান্ডারসান ক্লাবে কবিগুরুর ‘শাপমোচন’ এবং ‘শ্যামা’ ছিল অন্যতম। শুধু তাই নয়, মীনাক্ষী ছিলেন একজন জাতীয় স্তরের খেলোয়াড়ও! তিনি ভলিবল আর কার রেসিং-এও প্রতিনিধিত্ব করেছেন ভারতের হয়ে। তবু জনপ্রিয়তার শিখরে তিনি পৌঁছন ‘দজ্জাল শাশুড়ি’ রূপে। পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমায় ‘ছোট বউ’তে চরিত্রের পর থেকেই তাঁর অভিনয় বাঁধা পড়ে যায় এক ধাঁচে।

‘ঘরের বউ’ থেকে ‘শ্বেত পাথরের থালা’ একাধিক ছবিতে তিনি এমনই এক রুক্ষ, অত্যাচারী শাশুড়ি। বাস্তবে নরম স্বভাবের হলেও পর্দায় তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপ দর্শকের মনে কাঁপন ধরাত। তাঁর বৌমার চরিত্র করেছেন সন্ধ্যা রায়, অপর্ণা সেনের মতো নামজাদা অভিনেত্রীরা। তবুও প্রতিভাশালী অভিনেত্রীদের ছায়ায় ঢাকা পড়েননি মীনাক্ষী। অনেকেই জানেন না, উত্তমকুমারের শেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে মীনাক্ষী গোস্বামী ‘লোলা বোস’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এর আগে ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছবিতে তিনি ইতিবাচক চরিত্রে কাজ করেছেন।

তবে দর্শকের মন কাড়েন নেগেটিভ চরিত্রেই। এলাহাবাদের এই কন্যা মঞ্চে থেকে সিনেমার জগতে প্রবেশ করেন, কিন্তু টলিউডে তাঁর প্রতিভার প্রাপ্য সম্মান তিনি পাননি কখনও। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে বারবার টাইপকাস্ট করা হয়, যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে শিল্পীর প্রতি এক বড় অবিচার বলেই বিবেচিত হয়। শেষ অধ্যায় ছিল তাঁর জীবনে বড়ই কঠিন, ২০১২ সালে নিঃশব্দে চলে গেলেন মীনাক্ষী গোস্বামী। টলিউডে বা সংবাদমাধ্যমে বড় কোনও শোকপ্রকাশ হয়নি।

আরও পড়ুনঃ ‘অমর সঙ্গী’র পর ফের ছোট পর্দায় ফিরছেন শ্যামৌপ্তি মুদলি! নতুন চরিত্রে বিশেষ চমক! নতুন রূপে দেখা যাবে, কোন ধারাবাহিকে?

সংবাদপত্রের এক কোণে ছোট্ট একটি বাক্সে সীমাবদ্ধ থেকেছে তাঁর প্রয়াণ সংবাদ। অথচ তিনি ছিলেন এমন এক শিল্পী যাঁর জীবন ছিল প্রতিভা, পরিশ্রম ও আত্মসম্মানে ভরপুর। আজ যখন তাঁর সংলাপ ট্রেন্ডিং মিমে রূপ নেয়, এত আলোচিত হয়ে, তখন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে একটাই প্রশ্ন যে আমরা আদৌ চিনেছিলাম তো এই নারীকে?