যাঁর নাম উচ্চারিত হলেই বাংলা বিনোদন জগতে এক ধরনের আস্থার অনুভূতি তৈরি হয়। তিনি অভিনেত্রী ‘অপর্ণা সেন’ (Aparna Sen)। এমন একজন শিল্পী, যাঁর কাজ বরাবরই বুদ্ধিদীপ্ত, সংবেদনশীল এবং সময়ের সঙ্গে কথোপকথনে বিশ্বাসী। পরিবারসূত্রে সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল ছোটবেলা থেকেই। একদিকে চলচ্চিত্র সমালোচক বাবা, অন্যদিকে সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত মাতৃপরিবার, এই দুই ধারার প্রভাব তাঁকে গড়ে তুলেছিল আলাদা মানসিকতায়। ফলে অভিনয় বা পরিচালনা, যাই হোক না কেন, তাঁর কাজের মধ্যে চিন্তার গভীরতা বরাবরই চোখে পড়ে।
অভিনয়ের জগতে তাঁর প্রবেশ খুব অল্প বয়সেই এবং সেই শুরুটাও ছিল স্মরণীয়। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়া তখনও সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি নিজের উপস্থিতি দিয়েই আলাদা করে নজর কাড়েন। পরে একের পর এক জনপ্রিয় ছবিতে অভিনয় করে তিনি নিজেকে শুধু সফল নায়িকা হিসেবে নয় বরং সময়ের প্রতিনিধি হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেন। জনপ্রিয়তা এলেও তাঁর অভিনয়ে কখনও শীতলতা আসেনি, সাধারণ চরিত্রেও তিনি খুঁজে নিয়েছেন আলাদা মাত্রা যা দর্শকের মনে দীর্ঘদিন থেকে যায়।
তবে অপর্ণা সেনের পরিচয় কেবল অভিনয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অনেক শিল্পীর ক্ষেত্রেই পরিচালনায় আসা কঠিন হয়, কিন্তু তাঁর প্রথম ছবিই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে তিনি এই মাধ্যমটিকে কতটা গভীরভাবে বোঝেন। ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’ এর মাধ্যমে তিনি এমন এক ভাষা তৈরি করেন, যেখানে শহর, একাকীত্ব আর মানবিক টানাপোড়েন খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। পরবর্তী ছবিগুলিতেও নারীর অবস্থান, সম্পর্কের জটিলতা এবং সময়ের পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন।
বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে হিন্দি ছবিতেও তাঁর কাজ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিষয় নির্বাচন থেকে নির্মাণ, সব ক্ষেত্রেই তিনি ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি। একই সঙ্গে বাস্তব জীবনের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নেও তাঁর অবস্থান স্পষ্ট, যা অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দিলেও আলোচনা থামায়নি। সম্প্রতি টিভি নাইন বাংলার ‘ঘরের বায়োস্কোপ’ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে, কার্যত টলিউড নিয়ে নিজের হতাশা এবং দুঃখ তুলে ধরলেন তিনি। অবশ্যই তাতে ছিল না কোনও ক্ষোভ, ছিল শুধু পরামর্শ।
এদিন তিনি বলেন, “এত বছর ধরে আমি এখানে আছি, সুতরাং বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আমায় আনন্দিত করে, আলোড়িত করে আবার কখনও দুঃখিতও করে। আমি চাই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আরও অনেক উন্নতি করুক এবং বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর ষষ্ঠ সবথেকে বেশি ব্যবহৃত ভাষা। সারা পৃথিবীতে বাঙালি ছড়িয়ে আছে তাহলে, আমরা কেন তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না? কেন আমরা দর্শক বাড়াতে পারছি না? এগুলো আমি সবাইকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব।
আরও পড়ুনঃ ফের ছোটপর্দায় জোজো! নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে এই জনপ্রিয় গায়িকাকে! কোন চরিত্রে?
প্রযোজকরা একটু ভেবে দেখবেন, এটা আমার অনুরোধ। আমি যখন দেখি বাংলা ছবি কখনও অন্যরকম শক্তির কবলে পড়ে এবং সেই শক্তির কবলে পড়ে ছটফট করে, খুব কষ্ট হয়। একজন বাঙালি এবং টলিউড ইন্ডাস্ট্রি এতদিনে খুব মানুষ হিসাবে সেই অশুভ শক্তির কবলে এই ইন্ডাস্ট্রি পড়লে, আমার অন্তর থেকে কষ্ট হয়। আমি প্রতিবাদী, কারণ আমার ঠাকুরদা একজন ব্রাহ্মণ মিশনারী ছিলেন। শিল্পী হিসেবে অপর্ণা সেন কখনও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকতে চাননি, বরং সময়ের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন, আবার নিজের কাজের মধ্য দিয়েই সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।






