১৯৭৬-এর একটা ভুল সিদ্ধান্ত, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ঐতিহ্যের কাছে হার মেনেছিল মহানায়কের জনপ্রিয়তাও! শ্রোতাদের চাপে নতি স্বীকার, আকাশবাণীতে ফিরল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’! কেন ব্যর্থ হয়েছিল উত্তম কুমারের ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’?

বাঙালির সাংস্কৃতিতে মহালয়া (Mahalaya) এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেবীপক্ষের ভোর মানেই ভিন্ন এক আবেগ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ (Mahisasura Mardini) শোনার অভ্যেস আজও পাল্টায়নি। অথচ ১৯৭৬ সালের সেই অস্বাভাবিকভাবে হঠাৎই বদলে যায় সেই চেনা ছবি। পরিচিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বদলে বেজে ওঠে নতুন অনুষ্ঠান— ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। রাষ্ট্রশক্তির ইচ্ছায় যেন ইতিহাসকে বদলে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল সেবার, কিন্তু ফল হয় উল্টো! শ্রোতারা যে মানসিক বন্ধন তৈরি করে নিয়েছিলেন পুরাতনের সঙ্গে, তা ভাঙার সাহস বা সাধ্য কোনও কৃত্রিম প্রচেষ্টার ছিল না।

এই ব্যর্থ পরীক্ষার অন্যতম বড় আকর্ষণ ছিলেন ‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ (Mahanayak Uttam Kumar)। প্রথমে তিনি নাকি এই অনুষ্ঠানের অংশ হতে রাজি ছিলেন না। কারণ, তিনি জানতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠের আসল মর্যাদা। পরে বাধ্য হয়ে অংশ নিলেও তাঁর দ্বিধা থেকেই গিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কণ্ঠস্বর পুরো অনুষ্ঠানে শোনা গিয়েছিল মাত্র দু-আড়াই মিনিট। অথচ ব্যর্থতার ভার এসে পড়ে প্রধানত তাঁর কাঁধেই। উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে যে ঐতিহ্যকে ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল, তা শেষমেশ উল্টে গিয়ে মহানায়ককেই এক অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দেয়।

১৯৭৬ মহালয়া

অন্যদিকে, সঙ্গীত ও ভাষ্যপাঠের ক্ষেত্রেও ছিল তারকাখচিত আয়োজন। বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন ছিলেন ভাষ্যপাঠে। আর গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় সহ এক কিংবদন্তি শিল্পীরা। তবুও এই বিপুল আয়োজন মন ছুঁতে পারেনি শ্রোতাদের। মানুষ রঙিন আয়োজনের চেয়ে বেশি চেয়েছিলেন পরিচিত কণ্ঠের স্বাদ, যেখানে আবহ তৈরি হত বাণীকুমারের লেখনী আর পঙ্কজ মল্লিকের সুরের মেলবন্ধনে।

ব্যর্থ সম্প্রচারের পর যা ঘটেছিল, তা ছিল একেবারেই নজিরবিহীন। আকাশবাণীর অফিসে ক্ষোভে উত্তাল জনতার ভিড় জমে যায়। অসংখ্য শ্রোতা চিঠি পাঠিয়ে তাঁদের হতাশা ও ক্ষোভ জানাতে থাকেন। এমনকি এই ক্ষোভের অভিঘাত নাকি পৌঁছে গিয়েছিল দিল্লির সাউথ ব্লক পর্যন্ত! পরিণতিতে আকাশবাণীকে ২৬ সেপ্টেম্বরের ‘সবিনয় নিবেদন’ অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করতে হয় এবং পুরোনো মহিষাসুরমর্দিনীকে ফিরিয়ে আনতে হয়। তবে পরাজয়ের দায় কোনও একক মানুষের নয়।

আরও পড়ুনঃ “ভগবান যখন রঙ কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে, আমি সাদাতে চলে এসেছি!” “এখন একটাই প্রার্থনা করি…”— একের পর এক স্বামী, বাবা-শ্বশুরের আকস্মিক মৃ’ত্যু পাল্টে দিয়েছিল সুভদ্রা মুখোপাধ্যায়ের জীবন! শোকের ছায়া কাটিয়ে ফের কাজের জগতে ফিরলেন অভিনেত্রী!

পরাজয়ের কারণ উত্তমকুমার হোন বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কিংবা আকাশবাণীর তৎকালীন কর্তৃপক্ষ— সবারই সমান দায় ছিল এই ব্যর্থতার গল্পে। কিন্তু সবচেয়ে বড় শিক্ষা ছিল একটাই— মানুষের আবেগের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহ্যকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া যায় না। মহালয়ার ভোরে যে শিহরণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় আজও, তার বিকল্প এখনও পর্যন্ত কেউ তৈরি করতে পারেনি। আর তাই ১৯৭৬ সালের সেই ভোর শিখিয়ে দিয়েছিল, আবেগ আর সংস্কৃতিকে টলাতে গেলেই তার ফল হয় বিপরীত।