“আজও মহালয়া থেকে বিসর্জন নতুন জামা পরি না, কষ্ট হয়।” “বারান্দায় বসে থাকি, ছোট ছোট সব প্রজাপতি দেখি আর হাসি!”— কৈশোরের ক্ষত ভুলতে পারেননি, তাই আজও পুজোর আনন্দ এড়িয়ে চলেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়! কী আছে তাঁর দুঃসহ স্মৃতিতে?

ঢাকে কাঠি পড়েই গেছে, বাঙালির প্রাণের উৎসব আসতে আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন মাত্র! তারপরেই ভোরের আগমনী দিয়ে শুরু হবে মা দুর্গার (Durga Puja) আরাধনা। গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ ভরে উঠবে মানুষের ভিড়ে। ইতিমধ্যেই শরতের আকাশে পুজোর আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু তাতে মাঝে মাঝেই জমছে কালো মেঘ, হচ্ছে বৃষ্টিও। ঠিক তেমনই প্রত্যেক মানুষের মনেও ভিড় করছে নানান স্মৃতি। কারও কাছে এই সময়টা আনন্দ আর উৎসবের, কারও কাছে আবার ভীষণ কষ্টের।

পুজো যে কেবল নতুন সাজে মেতে ওঠার উৎসব নয়, বরং অনেকের জীবনে দুঃখ হিসেবেও ফিরে আসে—এই কথাই মনে করিয়ে দেন বর্ষীয়ান অভিনেতা ‘পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (Paran Bandopadhyay)। স্মৃতির পাতার ধুলো সরিয়ে, এদিন তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, পুজো তাঁকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক কঠিন সময়ে, যে সময়ে শুধুমাত্র অভাব আর দুঃখ ছিল তাঁর সঙ্গী। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই তিনি বাংলার দুর্গা পুজোর সাক্ষী ছিলেন। সপরিবারে কলকাতায় পা রাখেন ১৯৪৪ সালে।

তবে সেই সময়ের পুজো তাঁর কাছে কেবলই অস্পষ্ট স্মৃতি, কারণ চারপাশে তখন দাঙ্গা-হাঙ্গামার উত্তাল হাওয়া বইছিল। স্বাধীনতার জন্য দেশ জেগে উঠেছিল, আর তাঁর শিশুমনে সেই সময় উৎসবের আবহ দাগ টেকেছিল অনেকটা! তাঁর চোখে বর্তমান সময়ের পুজোও অনেকটাই বদলে গেছে। অন্তরঙ্গতা কমে গিয়ে বেড়েছে বড়সড় থিম আর প্রদর্শনীর ঝলক। তবে, তাঁর কৈশোরের সেই দিনগুলোর অভিজ্ঞতা যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। আজও তিনি ওই অশান্ত দিনগুলো মনে নিয়ে পূজোয় আনন্দ করতে পারে না।

ছোটবেলায় দমদমের সেই পাড়ার পুজো আজও তাঁর মনের গভীরে সমান উজ্জ্বল। তাঁর কথায়, অভাবের দিনগুলোতে আশেপাশের ছেলেমেয়েরা যখন ঝকঝকে নতুন জামাকাপড় পরে আনন্দে চারিদিক ঘুরত, তখন তাঁর নিজের পরনে থাকত পুরোনো, ছেঁড়া জামা। আত্মীয়স্বজনরা নতুন পোশাক কিনে দিলেও তিনি তা পরতেন না। ওই চারটি দিনে যেন অভিমান আর অদৃশ্য কষ্ট তাঁকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরত। আজও সেই স্মৃতি মুছে যায়নি। রোজগার শুরু করার পরেও সেই অভিমান তিনি বুকে লালন করেছেন।

কাজের সূত্রে ইন্ডাস্ট্রির বহু লোকেদের কাছ থেকে পুজোর সময় উপহার আজও পান। কিন্তু পুজোর দিনগুলোতে নতুন জামা না পরাই তাঁর অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহালয়া থেকে বিসর্জন পর্যন্ত নতুন পোশাকে আজও নিজেকে সাজাতে চান না তিনি। তাঁর কথায়, “ক্ষত শুকিয়ে গেলেও ব্যথা থেকে যায়।” আর সেই ব্যথাই তাঁকে মনে করিয়ে দেয় অতীতের দুঃসহ দিনগুলোর কথা। পুজোয় কখনোই ঠাকুর দেখতে যাননি তিনি। এমনকি প্রেমেরও স্মৃতি নেই, ভালোলাগা ছিল মণ্ডপ পর্যন্ত সীমিত।

আরও পড়ুনঃ “মীরা ভালবাসার মানুষকে বেছে নিলে, আমি তাঁর মতো আটকাব না!” “কন্যাসন্তানের মা আমিও…ওর ঠিক-ভুলের দায়িত্ব আমার, সম্পর্ক ভুলে পালাবো না!”— মা চাঁদনীর হয়ে নিন্দুকদের কটাক্ষের উত্তরে মনের কথা উগরে দিলেন অভিনেত্রী অহনা দত্ত!

এখন পুজো এলে তিনি বাড়ির দক্ষিণের জানলা খুলে বসেন। বাইরে যান না, বরং বারান্দায় বসে তরুণ থেকে শিশুদের নতুন জামাকাপড়ে ঘোরাফেরা দেখতে ভালবাসেন, যাঁদের তিনি ছোট্ট প্রজাপতি বলেন। বৃষ্টিতে যখন ওদের মুখ ভারী হয়ে যায়, তখনও তিনি দেখেন আর মুচকি হাসেন। যেন নিজের অচেনা অতীত আর বর্তমানের মিলন ঘটে যায় এই দৃশ্যগুলির মধ্যে। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখে তাই পুজো কখনও আনন্দ, কখনও অভিমান, আবার কখনও শূন্যতার নিঃশব্দ সাক্ষী।