বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ‘মা’ বলতেই যাঁর মুখ ভেসে আসে, তিনি ‘কানন দেবী’ (Kanan Devi)। এক জনপদের উঠোন থেকে উঠে আসা এই অসামান্য নারী হয়ে উঠেছিলেন বাংলা রুপোলি পর্দার (Tollywood) ‘দেবী’। কেউ খ্যাতিতে, কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তিতে, আবার কেউ সংজ্ঞার দোহাই দিয়ে দেবী হয়ে ওঠেন— কিন্তু কানন দেবীর মধ্যে দেবীত্ব এসেছিল তাঁর অপার মমত্ববোধ, হৃদয়ের আন্তরিকতা আর উন্নত মানসিকতা থেকে। কানন কোনোদিন নিজের খ্যাতিকে অহংকারের বস্তু বানাননি।
উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট না থাকলেও তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ছিল বিস্ময়কর। তিনি বলতেন, “কানন নামটাই যথেষ্ট।” তাঁর শৈশব ছিল অনাদরে ঢাকা। মা–মেয়ের ঠাঁই ছিল ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই কাননের মায়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি কাননকে নিয়ে যান স্টুডিওপাড়ায়। প্রথমদিকে কেউ তাঁকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও ভাগ্য বদলায় পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। ম্যাডান থিয়েটারে তাঁর প্রথম ছবি ‘জয়দেব’, রাধার ভূমিকায় নজর কাড়েন কানন।
পরে আসে সবাক ছবির যুগ, এবং ‘জোর বরাত’ সিনেমার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বাড়ে তাঁর। ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবির এক দৃশ্য দেখে দর্শকের পর্দা ভেদ করে ছুটে আসার ঘটনাই প্রমাণ করে, কী প্রভাব ফেলেছিলেন তিনি সেই সময়ে। তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া— পার্বতীর চরিত্রে তাঁকে কাস্ট করতে চেয়েছিলেন ‘দেবদাস’ ছবিতে। কিন্তু চুক্তিগত কারণে সেটা না হলেও ‘মুক্তি’ ছবিতে তিনি নায়িকা হয়ে বড়ুয়া সাহেবের সঙ্গে কাজ করেন। এই ছবিই তাঁকে প্রকৃত ‘তারকা’ মর্যাদা দেয়।
গায়িকা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। নজরুল, পঙ্কজ মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, আল্লারাখা— সকলের সান্নিধ্যে সংগীতে পরিণত হন তিনি। ‘আমি বনফুল গো’ থেকে ‘তুফান মেল’, বাংলার পাশাপাশি হিন্দি গানেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে কাননের মুখ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “কি সুন্দর মুখ গো তোমার!” কাননের ব্যক্তিগত জীবনও ছিল সিনেমার চেয়েও নাটকীয়। প্রথম স্বামী অশোক মৈত্র, যাঁর বাবা হেরম্বচন্দ্র মৈত্র কাননের মতো পিতৃ-পরিচয়হীন পুত্রবধূ চাননি।
বিয়ের পর অশোকও চাননি কানন তাঁর উত্তরসূরি ধারণ করুন বা সিনেমা জগতে থাকুন। কিন্তু কানন কারও ছায়া হয়ে থাকতে রাজি ছিলেন না। তিনি নিজের পথ বেছে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় স্বামী হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গেও সংসার টেকেনি, যদিও কাননের নামেই হরিদাস ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত হন, এবং পরবর্তীকালে পরিচালক হয়ে ওঠেন। খ্যাতি তার পা ছুঁতেই কাননকে ত্যাগ করেন তিনি। যদিও কানন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর জন্য টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন, এমনকি অসুস্থ অবস্থায় সেবাও করেছেন।
আরও পড়ুনঃ “টলিউড তখন রিমেকের ‘এঁটো খাচ্ছে’, হাত পেতেও কাজ পাইনি!” “সেটা না হলে আমিও ধূমকেতুর মতো দশ বছরে একবার ফিরতাম!”— সব পেরিয়ে দেব আজ নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান! সেই যন্ত্রণা থেকেই কি জন্ম ‘দেব এন্টারটেনমেন্ট ভেঞ্চার্স’-এর?
শেষজীবনে একাকীত্বে গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই কানন দেবীর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর খবরও প্রথমে একটা মাত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তারপর বাকিরা জানতে পারে। ইন্ডাস্ট্রির ‘মা’কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির হন মাত্র কয়েকজন। তবুও কানন দেবী আজও কিংবদন্তি, যাঁকে ছাড়া বাংলা সিনেমার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তাঁকে ‘মহানায়িকা’ বললেও তা কম বলা হয়, কারণ কানন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রাণ, মা, পথিকৃৎ এবং গর্ব।
Disclaimer: এই প্রতিবেদনে ব্যবহৃত মতামত, মন্তব্য বা বক্তব্যসমূহ সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি মাত্র। এটি আমাদের পোর্টালের মতামত বা অবস্থান নয়। কারও অনুভূতিতে আঘাত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, এবং এতে প্রকাশিত মতামতের জন্য আমরা কোনো প্রকার দায়ভার গ্রহণ করি না।